মিতালী মুখার্জি। ১৯৮২ সালে ‘দুই পয়সার আলতা’ ছবিতে একটি গান গেয়েছিলেন, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’। গানটি শোনেননি এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া ভার। এই গানের জন্য জিতেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘কেন আশা বেঁধে রাখি’ তার আরও একটি জনপ্রিয় গান।
মিতালী মুখার্জি ১৯৮২ সালে সংগীত বিষয়ে পড়তে ভারত যান। ভারতের প্রখ্যাত গজলশিল্পী ভুপিন্দর সিংহের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। এরপর থেকে যান মুম্বাইয়ে। গত বৃহস্পতিবার ‘চ্যানেল আই ক্ষুদে গানরাজ’ আয়োজনের গ্র্যান্ড ফিনালেতে অতিথি বিচারক হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন তিনি। গান ও অন্যান্য বিষয়ে কথা হয় চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে।
কেমন আছেন?
ভীষণ ভালো আছি।
ঢাকায় আসতে কেমন লাগে?
কত যে ভালো লাগে, বলে বোঝানো যাবে না।
ঢাকায় এসে কী খাচ্ছেন?
ভর্তা, মাছ, ইলিশ মাছ, মুরগী, ভাজি, শাক— এগুলোর এতো স্বাদ। দেশি খাবারগুলোই খাচ্ছি এবং খুব ভালো খাচ্ছি।
মুম্বাই থাকলে বাঙালি খাবার মিস করেন?
খুব একটা মিস করি না। কারণ, বাসায় আমার জন্য সবসময় বাঙালি খাবারটাই রান্না করি। তবে ওখানকার সবজিগুলো বাংলার সবজির মতো হয় না। এত তরতাজা হয় না।
বাঙালি খাবারে ভুপিন্দর নিংয়ের আগ্রহ কেমন?
ও তো বাঙালি খাবার বলতে অজ্ঞান। তবে মাছের কাঁটা বাছতে ওর একটু সমস্যা হয়। কাঁটা বেছে দিতে হয়। সর্ষে বাটা দিয়ে মাছ, কাসুন্দি দিয়ে রান্না শাক খুব ভালোবাসে।
জামাইবাবুকে নিয়ে এলেন না?
না, ও আসেনি। কাজ ছিল। তবে আগামীতে আসবে। আমরা কিন্তু প্রোগ্রাম করতে একসঙ্গে অনেকবার এসেছি।
ভুপিন্দর সিংয়ের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে কোনো ভাবনা জাগাতে পেরেছেন?
সে তো বাংলাদেশের ভক্ত। বাংলার মানুষের ভক্ত। সবাইকে বলে, বাংলাদেশের মতো শ্রোতা কোথাও পাওয়া যায় না।
বাবার ভিটা ময়মনসিংহে গেছেন?
না, এখনো যেতে পারিনি। তবে আগামী দিনে যাব। খুব মন টানছে।
আপনার একটা জনপ্রিয় গান ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’। গানের রেশ ধরে যদি বলি, ‘এই মিতালী এখন তো আর সেই মিতালী নাই…’
এ কথা বলার একটুও সুযোগ নাই। কারণ, একটু স্বাস্থ্য বেড়েছে হয়তো। মনের দিক দিয়ে একটুও পরিবর্তন হয় নাই। মনের দিক দিয়ে এখনো সেই মিতালীই আছি।
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসতেন গান গাওয়ার জন্য। এখন মুম্বাই থেকে ঢাকা আসছেন গানের কাজ করতে। দুইটা জার্নির বিশেষ কোনো পার্থক্য আছে?
যখন ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসতাম, তখন ঢাকা আমার কাছে একটা বিরাট বিস্ময় ও ভয়ের জায়গা ছিল। কারণ আমি আসতাম কম্পিটিশনের জন্য। কী হবে কী হবে এসব ভাবনা কাজ করত। আমাদের রাজধানীতে যাচ্ছি। বিরাট হৈ চৈ পড়ে যেত বাড়িতে। ঢাকা যাব ঢাকা যাব। একটা উৎসব কাজ করত কয়েকদিন ধরে। রাস্তা অনেক দূরের ছিল। অনেক সময় লাগত। এখন যখন মুম্বাই থেকে ঢাকায় আসি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না, এখানে আমার বাবা মা কেউ নেই, তারপরও মনে হয় আমার বাবার বাড়ি আসছি। সবার এত এত ভালোবাসা পাই যে পুরো বাংলাদেশটাই আমার বাড়ি মনে হয়। অল্প সময়ের মধ্যে চলে আসি। দেশের মাটিতে পা দিতে শিহরণ জাগে।
এবার ঢাকায় বিশেষ কোনো ঘটনা মনে নিয়ে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, গতকাল শুক্রবার রাতে যখন ক্ষুদে গানরাজ অনুষ্ঠান শেষ করে বের হয়েছি, ফরিদুর রেজা সাগরের স্ত্রী কণা রেজা আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি বের হওয়ার সাথে সাথে আমার খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এই খেয়ালটা, এই ভালোবাসাটা বাঙালি বলেই তারা করেন। আর কারও মাঝে দেখা যায় না। সত্যিই বাংলাদেশের মানুষের মতো মানুষ হয় না। টাকা পয়সা দিয়ে জিনিস কেনা যায়, কিন্তু ভালোবাসার মতো মন কেনা যায় না। এটা থাকতে হয়। অর্জন করতে হয়।
আপনাকে বলিউডের গানে দেখা যায় না। কেন?
আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়ে। আমি যখন পড়তে গিয়েছি, আমার বাবা বলেছিলেন, ‘পড়াশুনা করবা, আর বাড়িতে ফিরবা।’ বলিউড সম্বন্ধে বাবার একটা ভীতি কাজ করত। সেই ভয়টা আমাকেও গ্রাস করেছিল। আমি যখন ভারত যাই তখন লতা মুঙ্গেশকার ও আশা ভোঁসলের রাজত্ব চলছে। তারাই নাম্বার ওয়ান। তারপরও আমি বাংলা গান করেছি। আমার অনেক অফার এসেছে বলিউডে গান করার, কিন্তু সিনেমায় গান গাইব, বিষয়টা কেমন যেন লাগত। নিজের আত্মার তুষ্টি পাইনি বলেই ওপথে আগাইনি।
তারপরও একটা গান করেছিলেন?
হ্যাঁ, বাপ্পী লাহিড়ী একটা গান করিয়েছিল। এরপর বলেছিল, তুমিই একমাত্র মেয়ে যে, গানটা করার পর একটা থ্যাংকস দিতে আমাকে ফোন করোনি, বা আমার বাড়িতেও আসোনি। আমি এই কাজটা পারিনি। ওপথে আর পা বাড়াইনি। ফলে গজল নিয়েই আমি ভালো ছিলাম।
চ্যানেল আইয়ের আরেকটা রিয়েলিটি শো, ‘সেরা কণ্ঠ’র বিচারক হিসেবে কাজ করছেন?
হ্যাঁ। আমি তো মুম্বাইর ‘সারেগামা’র জাজ ছিলাম। তখন ওখানকার ডিরেক্টর আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে খুব ট্যালেন্টেড প্রতিযোগী অংশ নেয়। তবে তারা পল্লীগীতি চর্চা বেশি বেশি করে। অন্য গান কম করে ওরা। ক্লাসিক্যালে পিছিয়ে। কাল যখন দেখলাম ওরা ক্লাসিক্যালে ভালো করছে। গ্রুমিংটা খুব ভালো হচ্ছে। ফলে এইসব প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবী কিছু সংগীতশিল্পী বেরিয়ে আসবে। তাদের বেরিয়ে আসার সাক্ষী হতে পারাটা আনন্দের।
বাংলাদেশী শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
আপনারা এভাবেই আমাকে ভালোবাসবেন। আপনাদের ভালোবাসাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
ছবি : তানভীর আশিক