অসংসদীয় আচরণ, উন্মুক্ততা চর্চার ঘাটতি, আন্তর্জাতিক চুক্তি আলোচনা না হওয়ার পাশাপাশি দশম সংসদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুললেও গবেষণার মাধ্যমে এর কিছু ইতিবাচক দিকও খুঁজে পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সংসদের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে টিআইবি বলছে, সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি, আইনপ্রণয়নের সময় এবং বিলপ্রতি সময় বৃদ্ধির সঙ্গে কমেছে কোরাম-সংকট। আগের তুলনায় প্রধান বিরোধী দল সক্রিয় হওয়া চেষ্টা করছে, বেড়েছে নারী সদস্যদের উপস্থিতি।
‘পার্লামেন্টওয়াচ-দশম জাতীয় সংসদ: সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশন’ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব পর্যবেক্ষন তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহি পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এবং ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি সুলতানা কামাল।
সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত সংসদের সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশন নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক– উভয় দিক তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু সুপারিশও করা হয়।
ইতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রবন্ধে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য না হলেও আইন প্রণয়নে ব্যয়িত মোট সময়ের শতকরা হার আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে প্রতিটি বিল পাশের জন্য ৩১ মিনিট সময় লেগেছে, নবম সংসদে যা ছিল ২৫ মিনিট এবং ৮ম সংসদে ২৯ মিনিটি। প্রতি কার্যদিবসে সদস্যদের গড় উপস্থিতির হারও তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোট সদস্যের ৭১ শতাংশই বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। কোরাম সংকটের সময় কমেছে আগের দুই সংসদের তুলনায়। দশম সংসদে গড় কোরাম সংকট ছিল ২৮ মিনিট, যেখানে নমব সংসদে ছিল ৩৩ মিনিট এবং অষ্টম সংদে ৩৯ মিনিট।
বিরোধীদলের দ্বৈতনীতি অব্যাহত থাকার পরও সংসদে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ার কথা উল্লেখ করে গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে আগের অধিবেশনগুলোর তুলনায় বিরোধীদলের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন চতুর্থাংশের বেশি অধিবেশনে পুরুষ সদস্যদের তুলনায় নারী সদস্যদের বেশি উপস্থিতিতে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
নবম সংসদের চেয়ে দশম সংসদ কার্যকর কি না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সুলতানা কামাল বলেন: তা এখনই বলা যাবে না। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
‘‘এই সংসদ অনেক বেশি কার্যকর—এই উপসংহারে যাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে এখনো অনেক সন্দেহ রয়েছে।’’ বলেন সুলতানা কামাল।
সদস্যের বক্তব্যে অসংসদীয় শব্দের ব্যবহার, স্পীকারের কার্যকর ভুমিকার ঘাটতি, আইন প্রণয়নে সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, জনমত গ্রহনের সীমিত সুযোগ এবং বিরোধীদলের মতামত ও প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত না হওয়াকে চলমান সংসদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হয়েছে প্রবন্ধটিতে। এছাড়া জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিস পর্বে উত্থাপণ করে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত আলোচিত হত্যাকান্ড, জঙ্গি অপতৎপরতা এবং আর্থিক বিষয়ে অনিয়ম বিষয়ে সংসদে আলোচনা না হওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে নেতিবাচক কর্মকান্ড হিসেবে।
প্রশ্ন তোলা হয়েছে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধিবেশনে উপস্থাপিত না হওয়া এবং সংসদীয় উন্মুক্ততার চর্চার ঘাটতি নিয়েও। কমিটির কার্যক্রমে বিধির ব্যত্যয় ঘটায় এবং সুপারিশ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকায় তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে রিপোর্টে।
এছাড়া আইন প্রণয়ন ও প্রশ্নোত্তর পর্বে নারী সদস্যদের তুলনামূলক কম অংশগ্রহণ করাকে তুলে ধরা হয়েছে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড হিসেবে।
নেতিবাচক-ইতিবাচক উভয় কর্মকান্ড বিশ্লেষন করে সদস্যদের অংশগ্রহন, সংসদীয় কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, কমিটি কার্যকর করা এবং তথ্য প্রকাশ বিষয়ে ১১টি সুপারিশ করেছে টিআইবি।
‘সংসদ সদস্য আচরণবিধি বিল’ বিলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন-পরিবর্ধনসহ তা চুড়ান্তভাবে অনুমোদন, স্পিকারের জোরালো ভুমিকা, বিরোধীদলের দ্বৈত অবস্থান থেকে সরে আসা, আইন প্রণয়নে জনমত যাচাই, পিটিশন কমিটিকে কার্যকর এবং আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশসহ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশযোগ্য নয় এমন বিষয় ব্যতীত অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো সদস্যদের আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপন এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশেরও সুপারিশ করা হয়েছে টিআইবির গবেষণা প্রবন্ধে।