সুশীল সমাজ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রাণের দাবী বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহাল করা। সামরিক শাসকদের বুটের তলে পিষ্ট হয়ে নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়া বাহাত্তরের সংবিধানটিকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এরকম একটি সরকার আকাঙ্ক্ষা করছিলো তারা।
১৪ দলীয় জোটকে এই প্রত্যাশাতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির এই বিশাল বিজয়কে নিজেদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিশ্বাসহীনতা, ভোট হারানোর স্থূল ভীতি, আদর্শিক দৃঢ়তার অভাব, ষড়যন্ত্র ও একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের আন্দোলন ভীতিতে বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করা গেলো না।
সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সুযোগ ব্যবহার করতে না পারার ব্যর্থতার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে। এই ব্যর্থতার দায় কতদিন মাথায় বয়ে বেড়াতে হবে কে জানে। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। মানুষের ধর্ম থাকবে, রাষ্ট্র মানুষ নয় একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ধর্ম নেই।
একাত্তরের পরাজিত শত্রু তথা যুদ্ধাপরাধী ও তার দোসররা প্রচার করে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। ক্ষমতালিপ্সু ধর্ম বণিকরা এজন্যই এটা প্রচার করে থাকে যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তারা এ-ও জানে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্মের প্রতি দুর্বল। ইসলাম গেলো, ইসলাম গেলো বলে অপপ্রচারনা চালিয়ে মুসলমানদের নিজেদের পক্ষে টানলেই তারা ক্ষমতায় চলে যেতে পারবে।
এক্ষেত্রে ভারতে হিন্দু মৌলবাদ ও এদেশে মুসলিম মৌলবাদ এক সুতোয় গাঁথা। তারা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির বানিয়ে সেখানকার হিন্দুদের সমর্থন আদায়ের অপপ্রয়াস চালায় আর এদেশে মুসলিম মৌলবাদীরা হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের অপপ্রয়াস চালায়। এক্ষেত্রে হিন্দু মৌলবাদীদের মধ্যে ধর্মীয় আদর্শের কোনো ব্যাপার নেই মুসলিম মৌলবাদীদের মাঝেও নেই।
রয়েছে শুধু মতলববাদিতা ও ক্ষমতান্ধ অনাদর্শিক সুবিধাবাদ। এই মধ্যযুগীয় অস্ত্রটি বাংলাদেশের সামরিক শাসকরাও ব্যবহার করেছে। তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানটিকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে গেছে তারা। সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি হওয়ায় দেশের মানুষ আশা করেছিলো, সব জঞ্জাল সাফ করে দেশ আবার বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবে। কিন্তু বিশেষ কমিটি এই আশা পূরণ হতে দেয়নি। তারা ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও বিসমিল্লাহকে আরও জায়েয করে দিয়েছে।
স্বীকৃতি দেয়া হলো না আদিবাসী জাতিসত্তারও। রয়ে গেলো পাহাড়ে আবার নতুন করে অসন্তোষ সৃষ্টির আশংকা। যে রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সেই রাষ্ট্রে সংযোজিত হলো ধর্মনিরপেক্ষতাও। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয় কী করে। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলে ধর্মনিরপেক্ষতা রইল কোথায়। এই পরস্পরবিরোধী সাংঘর্ষিক সংবিধান রচনার কুফল ভোগের রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির স্বীকৃতির পথ পেয়ে জামাতীরা নতুন উদ্যমে মাঠে নেমে পড়েছিল। তারা যেনো এরকম একটি সংবিধানের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। তা আদায়ও করে নিলো জাতির পিতার কন্যার নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বারা।
সামান্য সুযোগ পেলেই দেশ ফিরে যেতে পারবে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানে। ভুলের পরিণতি সংশোধন সংশোধনে ভুল হলে এর পরিণতি সহজ হয় না, হয় জটিল এবং ভয়াবহ। আমরা তার আলামতও দেখতে পেয়েছি বেশ। এ ব্যাপারে সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি ও প্রধান শরীক আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক মহল কী ভাবছেন তা তারাই জানেন দেশের মানুষের জানার উপায় নেই। দেশের মানুষ দেখেছে রাজপথে জামাতীদের জঙ্গী চেহারা। দেশের মানুষ দেখেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ও তার মদতদাতাদের মাঝে কোন দ্বিধা নেই। তাদের অবস্থান, অস্তিত্ব রক্ষা ও করণীয় সম্পর্কে তারা পুরোপুরি অবগত। তাদের ভূমিকা কখনও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির সহায়ক হিসেবে কাজ করে না। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি বারবার ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত সেই সব দেশদ্রোহীদের অবস্থানিক ভিত শক্ত করতে সহায়তা করে যাচ্ছে। এ যেনো হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে বাঁচতে প্রতিরোধ চেষ্টা করা। বলা হচ্ছে , জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। যে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সেখানে ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ কী করে বন্ধ হবে।
সুতরাং আমরা কি বলতে পারি না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির রাজনীতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা যদি বলি এই সাংঘর্ষিক সংবিধান যারা রচনা করেছেন তারা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছেন। এই কুড়ালের হাতল ভাঙ্গতে ও শান দেয়া বন্ধ করতে হলে কী প্রয়োজন তা নতুন করে ভাবা জরুরি নয় কি?
সেক্ষেত্রে আমরা সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি গঠনের পর আবারও কি সংশোধিত সংবিধান পুনরায় সংশোধনে বিশেষ কমিটি গঠনের দাবী করব? এর যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতা নিয়ে সংবিধান বোদ্ধা মহল ভাববেন বলে আশা করছি। আমরা চাই বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহাল ও সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
বিএনপি যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে দেখাল সেটা কি ভয়ংকর দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সমূহ সম্ভাবনা নয়? যদি আবার বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় যায় তখন সাংবিধানিক শক্তিতে বলীয়ান হয়েই দেশদ্রোহীরা জোট বেঁধে প্রগতি শীলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঝাঁপিয়ে পড়বে আওয়ামী লীগেরও উপর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম একটি দুঃস্বপ্নের আগমন প্রতিহত করতেই সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে, বাহাত্তরের সংবিধান পুনর্বহাল ও তার বাস্তবায়নে নাগরিক কমিটি হয়েছিলো। সেই কমিটির কার্যক্রম জোরালো ভাবে সচল করা দরকার নয় কি। আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে খুবই দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে গঠন মূলক সমালোচনা সহ্য করতে না পারা।
সমালোচকদের গুরুত্ব না দিয়ে তোষামোদ কারী হিপোক্রেটদের গুরুত্ব দেয়া ও বিশ্বাস করা। যে মীরজাফরের চক্রান্তে ১৮৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে দেশপ্রেমিক সিরাজ উদ্দৌল্লাহর পতন হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।মীর জাফরের উত্তরসূরি খন্দকার মোশতাক চরিত্র সম্পর্কে বলতে গেলে ১৯৭৪ সালের ১৯ মার্চের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মস্কোতে যাচ্ছিলেন।
তেজগাঁও বিমান বন্দরে মন্ত্রীসভার সদস্যরা তাকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেই বিমানের সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছেন ঠিক তখনই মোশতাক দৌড়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর পা জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন :আপনার অপারেশন সফল না হলে আপনি ফিরতে না পারলে আমরা কাকে নিয়ে দেশ চালাবো। হিপোক্রেট মোশতাক অত্যন্ত কৌশলে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট হয়ে যান। দিনরাত কানভারী করে তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে দেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে কি আবারও সক্রিয় রয়েছে চতুর মোশতাকের উত্তরসূরীরা? তারা কি সংবিধানে আদিবাসীদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি না দিয়ে আবারও কি পাহাড়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছেন? যখন সমালোচকদের সমালোচনাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, আপনারা শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। আমরা তখন বুঝতে পারি যে রাজনীতির মূল স্রোতধারা আবারও সেই তোষামোদকারীর খপ্পড়ে পড়েছে।
সেজন্যই সমালোচনাকে ভয় পাচ্ছেন। মাওসে তুঙ তার পাঁচটি দার্শনিক প্রবন্ধ গ্রন্থে সমালোচনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, একটি গাছের চারা লাগিয়ে যদি উপর নিচসহ কাঁচের বেড়া দিয়ে দেয়া হয় তখন গাছটি ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। আর বাড়বে না। আলো বাতাস না পেয়ে গাছটি ক্রমশ নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে। আর যদি গাছটি খোলা আকাশের নিচে রাখা হয় তবে গাছটি ঝড়ে আক্রান্ত হবে, ডাল ভাঙ্গবে। রোদে পুড়বে, বৃষ্টিতে ভিজবে, গরু ছাগলে পাতা খাবে, পথিক ডাল ভাঙ্গবে। এইসব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করেই তবে চারাটি বেড়ে উঠবে। তখনই গাছটি পরিপূর্ণ গাছে পরিণত হবে।
গণতন্ত্রের সুষ্টু বাস্তবায়নে আলোচনা, সমালোচনা, বিরোধিতা অপরিহার্য। সমালোচনা বিহীন রাজনীতি কাঁচের দেয়াল ঘেরা গাছের চারাটির মত। আমরা চাই সমালোচনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনীতির গণমুখী সুদৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি। আমরা বলতে চাই যারা সমালোচনা করছেন তারা শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন না শত্রুদের হাতে অস্ত্র হাতে নেয়ার সুযোগ বন্ধ করতে চাচ্ছেন। অতএব সময় থাকতে সাবধান।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)