চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শ্রীলঙ্কার কৃষকেরা বলছেন, আমাদের আর কোনো আশা নেই

'মানবসৃষ্ট' খাদ্য সঙ্কটের মুখোমুখি লাখ লাখ কৃষক

‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, আমি জানি না এখন কী করবো? আমি একবার আকাশের দিকে তাকাই, আরেকবার জমিনের দিকে তাকাই আর অপেক্ষা করি’- এভাবেই নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটে পড়া শ্রীলঙ্কার একজন কৃষক।

দেশটিতে বছরের এই সময়ে, কলাক্ষেতের বেশিরভাগ গাছের উচ্চতা হতো দ্বিগুণ। ফুলে ফুলে ভরে উঠতো গাছগুলো। কিন্তু এই কৃষকের আগাছা ছড়ানো মাঠের ১ হাজার তিনশ’টি গাছের মধ্যে মাত্র কয়েকটিতে ফুল এসেছে। জমিতে চাষ করে বছরে ৩৭ হাজার কেজি কলা পেতেন তিনি। অথচ এবার মাত্র ৬ হাজার কেজি কলা পেতে পারেন।

আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রীলঙ্কার ওয়ালসাপুগালা এলাকার কৃষক মাহিন্দা সামারাবিক্রেমা জানেন না আগামী দিনগুলোতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে৷

রাসায়নিক সারের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞার পরে গত মার্চের ফসল কাটার সময় তার ধানের ফলন অর্ধেকে কমে যায়। ৮ হেক্টর (২০ একর) জমিতে ধান এবং কলাবাগানের মালিক সামারাবিক্রেমা বলেন, তার এখন একটি খামার পরিচালনার মতো আয় নেই। বিশেষ করে কলার ফলনও ব্যর্থ হওয়ায় এই মৌসুমে আর ধান চাষও করবেন না তিনি।

সামারাবিক্রেমার মতো ওয়ালসাপুগালা গ্রামের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র কৃষকরা বলছেন, তারা এই মৌসুমে তাদের ক্ষেতে সেচ দেবেন না।

শ্রীলঙ্কায় মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলা এই মৌসুমকে বলা হয় ইয়ালা মৌসুম। কৃষকদের মতে, সার নিষেধাজ্ঞা কারণে ফসলের চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া দেশব্যাপী জ্বালানীর ঘাটতির এই কৃষি ব্যবস্থাকে আরও করুণ করে তুলছে।

বেগুন চাষী কে এ সুমনদাসা বলেন, এখন আর চাষ করে লাভ নেই। এর আগে ফসলের যে ফলন হয়েছে তাতে তার জমির আগের বিনিয়োগের টাকায় উঠবে না জেনেই হতাশ তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখন চাষাবাদের ঝুঁকি নিতে পারবো না, এখন কেবল শুধু আমার পরিবারকে খাওয়ার যোগান দেয়ার মতো ফসল চাষ করবো।’

দেশটির একটি বেসরকারি সংস্থা ভূমি ও কৃষি সংস্কার আন্দোলন (এমওএনএলএআর) বলছে, হাম্বানটোটা জেলার আশেপাশের এবং উত্তরের প্রধান কৃষি অঞ্চল যেমন অনুরাধাপুরা এবং পোলোনারুওয়া জেলার অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষকরাও এই মৌসুমে চাষাবাদ বন্ধ করে দিচ্ছে। কৃষকদের খাদ্য চাষ বন্ধ করে দেয়া শ্রীলঙ্কাকে আরও কঠিন সঙ্কটে ফেলে দিতে পারে বলে বক্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

শ্রীলঙ্কা কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির প্রেসিডেন্ট গামিনি সেনানায়েকে বলেছেন, খাদ্যের দিক থেকে আগামী কয়েক মাসে খুব কঠিন সময় আসবে। খাদ্য ঘাটতি হবে এবং আমাদেরকে এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সার নিষিদ্ধ
২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা একসময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু সার এবং কীটনাশকসহ সমস্ত সিন্থেটিক কৃষি রাসায়নিক নিষিদ্ধ করে দেশটিকে সম্পূর্ণরূপে জৈব কৃষি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের অভিযান দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়েছে৷

এর আগে মাটিতে অতিরিক্ত নাইট্রেট এক্সপোজারের কারণে কৃষকদের জটিল কিডনি রোগ এবং মাটির ঊর্বরতা হ্রাস হচ্ছে বলে ধারণা করার পর এ সমস্যা সমাধানে গত বছরের মে মাসে রাতারাতি এর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

ফলশ্রুতিতে মার্চ মাসে শেষ হওয়া ভরা মৌসুম যাকে কৃষকরা স্থানীয় ভাষায় মহামৌসুম বলে থাকে এই সময়ে কৃষি উৎপাদনে লক্ষ্যণীয় ধ্বস দেখা যায়।

এই মহামৌসুমে কতোটা ক্ষতি হয়েছে- তার সরকারী পরিসংখ্যান জানা না গেলেও ফসলের উপর নির্ভর করে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ ফলন হ্রাস হয়েছে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই অনুমান অনুসারে শ্রীলঙ্কায় চালের ক্ষেত্রে মহামৌসুমে দেশব্যাপী ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। যার ফলে দ্বীপরাষ্ট্রটির বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে এটি ২০২০ সালে আমদানি করা ১৪ হাজার মেট্রিক টনের তুলনায় অনেক বেশি।

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়
এপ্রিলের শেষে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাস পেয়ে ১৮০ কোটি ডলারে পতিত হয় এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে সরকার কীভাবে তার ২০ লাখ কৃষকের জন্য পর্যাপ্ত মাটির জন্য সার আমদানি করতে পারবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

শ্রীলঙ্কার কৃষি বিভাগের প্রাক্তন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী লিওনেল ওয়েরাকুন বলেছেন, সরকার এবং বেসরকারী দলগুলো ২০২০ সালে সার আমদানিতে প্রায় ২৫৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে৷ ২০২১ সালের বিলে ৩০০ থেকে ৪৪০ মিলিয়নের মধ্যে ছিলো এর ব্যয় যা এই বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ লাগতে পারে বলে জানান ওয়েরাকুন৷

তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ কারণ রাশিয়া, বেলারুশ এবং চীন তাদের সার রপ্তানি সীমিত করে দিয়েছে। যদি আমরা ২০২০ সালের মতো একই পরিমাণ সার কিনতে চাই, তাহলে আমাদের ৬০০ মিলিয়ন খরচ করতে হতে পারে।’ এই সরকারের অধীনে দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় হয়েছে। খাদ্য সঙ্কট যা বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে তা আরও বাড়তে পারে।

শ্রীলঙ্কার পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক জিউইকা ওয়েরাহেওয়া শ্রীলঙ্কার খাদ্য  সঙ্কটকে ‘একটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, দেশটির ‘গর্ভবতী মহিলাদের এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের মধ্যে অপুষ্টি এবং শৈশবকালীন অপুষ্টির মতো গুরুতর সমস্যা তৈরি হবে।’

‘‘আগামী চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে আমরা এখন যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তার চেয়েও বেশি কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে।’’

ওয়ালসাপুগালার কৃষকরা তাই এখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, সরকার এখন কৃষি রাসায়নিকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও, কৃষকেরা পর্যাপ্ত সারের বর্তমান যে বাজার দাম তা বহন করতে পারছে না।

সামারাবিক্রেমার মতো এক কলাচাষী অজিত কুমার বলেন, আমাদের জীবনধারা ধ্বংস হয়ে গেছে৷ আমরা ক্ষুদ্র কৃষক, আমাদের কোনো সঞ্চয় নেই, এখন আমরা চাষাবাদও করতে পারছি না, তাই আমরা আগের নেয়া ঋণও শোধ করতে পারছি না, সন্তানদের শিক্ষাও নিশ্চিত করতে পারছি না।

হতাশায় তাই অজিত বলেন, ‘এই দেশে আমাদের কোনো আশা বাকি নেই।’