আমরা যৌবনে যাদের সিনেমা দেখে মুগ্ধ হতাম, শ্রীদেবী ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ভূবনমোহিনী হাসি আর চোখ ধাঁধানো চেহারা দেখে সেই সময় কতো শত যুবকের স্বপ্ন-মধুর প্রহর কেটে যেত। শ্রীদেবী আমাদের সময়ে এতটাই ক্রেজ হয়ে উঠেছিলেন যে, আমরা যেকোন সুন্দরী মেয়েকেই ‘শ্রীদেবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করতাম। এমনকি কারো প্রেয়সীকে ইঙ্গিত করেও বলতাম, ‘তোর শ্রীদেবীর খবর কী?’
হ্যাঁ শ্রীদেবী-আমাদের যৌবনে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে ছিল অসংখ্য যুবকের ‘হৃদয়ের রাণী!’ তিনি আকস্মিকই চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। যিনি এসেছিলেন রাঙাতে, আলোর মৌতাতে মাতাতে, সেই তিনিই বসন্ত-সকালে চিরবিদায় নিলেন এক মরুশহরে। আচমকাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন শ্রীদেবী। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৪ বছর। শনিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ মারা যান তিনি। পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে দুবাইয়ে ছিলেন শ্রীদেবী ও তার পরিবার।
সকাল বেলায় খবরটা শুনেই কেমন যেন বুকের ভেতর যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। গাছে গাছে আমের মুকুল, ঝাঁকে ঝাঁকে রক্তিম পলাশ-শিমুল! লাল রঙে এত বিষণ্ণতা আগে দেখেছি বলে মনে হয় না! সত্যি যেন ফিকে হয়ে গেল আমাদের অনেকের ছেলেবেলা! চলে গেলেন ‘রূপ কি রাণী’! তার এই মৃত্যু সিনেমাপ্রেমীদের জন্য সত্যিই যেন একটা পাঁজর-ভাঙ্গা সংবাদ! বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই সুন্দরী নায়িকা জীবন থেকে আচমকা সরে গিয়ে স্মৃতি হয়ে গেলেন সবার কাছে।
শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গের আয়্যাপান। এই সুন্দরের চেনা নাম হল শ্রীদেবী। তামিলনাড়ুতে ১৯৬৩ সালের ১৩ অগস্ট জন্মগ্রহণ করেন শ্রী। বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী। এক বোন ও দুই সৎভাই নিয়ে যৌথ পরিবারে দখিনি আদর্শে বেড়ে ওঠা তার। একবার এক সাক্ষাতকারে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘এমন একটা পরিস্থিতি এসেছিল যখন সিনেমা আর পড়াশোনার মধ্যে আমাকে একটা বেছে নিতে হয়েছিল। আমি সিনেমা বেছেছিলাম। ইশ! যদি আরও একটু পড়তে পারতাম!’
মাত্র চার বছর বয়স থেকে অভিনয় করেছেন শ্রীদেবী। আট বছর বয়সে, ১৯৭১ সালে মালায়লাম সিনেমা ‘পুমবাতা’য় অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা শিশু অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।
১৩ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে ‘মন্দ্রু মুচিহো’ নামে তামিল সিনেমায় অভিনয় করেন। তার আগের বছর হিন্দি ছবি ‘জুলি’তে। চলচ্চিত্রজীবনে তিনি তামিল, তেলুগু, মালায়লাম, কন্নড় ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এক সঙ্গে টানা কাজ করার অভিজ্ঞতা আর সেই সঙ্গে কমিক থেকে রোমান্টিক রোলে অনায়াস অভিনয় তাকে নায়কদের একচেটিয়া রাজত্বে নব্বই দশকের সুপারস্টার করে দিয়েছিল। শ্রীদেবী তাই একক অভিনেতা। হিন্দি চলচ্চিত্রে যে কয়েক জন অভিনেত্রী পুরুষ সহকর্মীর সহায়তা ছাড়াই বক্স অফিসে ঝড় তুলতে পেরেছিলেন, তাদের মধ্যে তাকে অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।
১৯৭৮ সালে ‘ষোলওয়া সাওয়ান’ ছবি দিয়ে বলিউডে পা রেখেছিলেন শ্রীদেবী। সৌন্দর্য্য ও প্রতিভার অধিকারী এই অভিনেত্রীকে মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই জিতেন্দ্রর বিপরীতে ‘হিম্মতওয়ালা’ ছবিতে দেখা যায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রূপে ও গুণে দর্শকদের মুগ্ধ করে ফেলেন শ্রীদেবী। হিন্দি ছবির প্রভাবশালী অভিনেত্রীদের তালিকায় চলে আসেন তিনি। ভারতীয় সেরা অভিনেত্রীদের ঘোড়দৌড়ে নিজের জায়গা পাকা করেন। পাঁচ দশকের অভিনয় জীবনে (মাঝে ১৫ বছর সরে ছিলেন) তিনি তিনশো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য ছবিতে রূপ-গ্ল্যামার এবং অভিনয় দক্ষতায় নজর কেড়েছেন তিনি। এককালে বলিউডের এই হট গ্ল্যামার-কোশেন্ট সংসার সামলেও সেকেন্ড ইনিংসে দাপিয়ে কামব্যাক করেছেন। ছয় ছক্কা হাঁকিয়ে জিতে নিয়েছেন কোটি কোটি দর্শকের হৃদয়। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে- সদমা (১৯৮৩): ত্যাগরাজনের প্রযোজনায় এবং বালু মহেন্দ্র-র পরিচালনায় ১৯৮৩ সালে তৈরি হয় সদমা। শৈশবে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ের চরিত্রে দেখা যায় বলি ডিভাকে। শ্রীদেবী এবং কমল হাসন অভিনীত এই ছবিটি বলিউডে ক্ল্যাসিক ছবির তকমা পায়।
নাগিনা (১৯৮৬): এক ইচ্ছাধারী নাগিনের চরিত্রে শ্রীদেবীর অসাধারণ অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শককে। অমরেশ পুরীর বীণের তালে তালে ‘ম্যায় তেরা দুশমন’ গান এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে।
মিস্টার ইন্ডিয়া (১৯৮৭): আটের দশকে বক্স অফিস কাঁপানো ছবি ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’। সেই সময় দাঁড়িয়ে শেখর কাপুরের ছবিটির কনসেপ্ট দর্শকমহলে খুবই জনপ্রিয় হয়।
চাঁদনী (১৯৮৯): যশ চোপড়ার ‘চাঁদনী’ এক সময় বক্স অফিসে সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। পর্দায় ঋষি কাপুর এবং শ্রীদেবীর রোম্যান্স মুগ্ধ করেছিল সকল বয়সের দর্শককে।
চালবাজ (১৯৮৯): পঙ্কজ পরাশর পরিচালিত ‘চালবাজ’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। ছবিটিতে ‘অঞ্জু’ এবং ‘মঞ্জু’ নামে যমজ বোনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় শ্রীদেবীকে। ছবিটিতে একই সঙ্গে দু’টি ভিন্ন চরিত্রের স্বাদ এনে দেন শ্রীদেবী।
লমহে (১৯৯১): ‘লমহে’তে শ্রীদেবী ও অনিল কাপুরের অনস্ক্রিন রোম্যান্স পছন্দ করেছিলেন দর্শকরা। ছবিটি দুর্দান্ত সাফল্য পায় বক্স অফিসে।
খুদা গাওয়া (১৯৯২): অমিতাভ বচ্চন ও শ্রীদেবী অভিনীত ‘খুদা গাওয়া’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯২ সালে। নাজির আহমদ এবং মনোজ দেশাইয়ের ‘খুদা গাওয়া’ বক্স অফিসে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল।
জুদাই (১৯৯৭): রাজ কানওয়ারের ‘জুদাই’ ছবিতে এক লোভী গৃহবধূর চরিত্রে শ্রীদেবীর অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। ছবিটিতে নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় শ্রীদেবীকে।
ইংলিশ ভিংলিশ (২০১২): বিয়ের পর অভিনেত্রীদের সেকেন্ড ইনিংস নাকি তেমন সফল হয় না। এই মিথকে ভেঙেছেন মিস ‘হাওয়া হাওয়াই’। ২০১২-য় মুক্তিপ্রাপ্ত গৌরী শিন্ডের ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ ছবিতে ‘শশী’ চরিত্রে শ্রীদেবীর অভিনয় মাতিয়ে দিয়েছিল সিনেপ্রেমীদের। বক্স অফিসে চূড়ান্ত সাফল্য পায় এই ছবি।
মম (২০১৭): কামব্যাকের পর শ্রীদেবী অভিনীত সেরা ছবিগুলির একটি রবি উদিয়া পরিচালিত ‘মম’। ছবিটি সন্তানের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে একজন মায়ের লড়াইয়ের কাহিনি। মায়ের ভূমিকায় শ্রীদেবীর অভিনয় মুগ্ধ করে দর্শককে।
তামিল সিনেমায় শিশু শিল্পী হিসাবে কাজ শুরু করা শ্রীদেবী দক্ষিণ ভারতকেও বঞ্চনা করেননি। দক্ষিণের সুপারহিরো রজনীকান্ত, কমল হাসান থেকে শুরু করে চিরঞ্জীবী সকলের সঙ্গেই কাজ করেছেন চুটিয়ে।
১৯৯৭ সালে তার ‘জুদাই’ সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর এই বৈচিত্রময় অভিনেত্রী চলচ্চিত্রশিল্পকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর পর দীর্ঘ ১৫ বছরে আর কোনও অভিনয় করেননি। সাম্রাজ্য থেকে আচমকা সরে এলেন। কারণ তখন তিনি মা হিসেবে নিজেকে দেখতে চাইলেন। ‘যে মানুষ ঈশ্বরের দেখা পায় না, সে মাকে পায়’— ‘মম’ ছবির সবচেয়ে প্রিয় সংলাপকে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি।
কিন্তু ২০১২ সালে ‘ইংলিশ-ভিংলিশ’ সিনেমার মাধ্যমে আবার চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসেন। ১৫ বছর পর সেই নির্বাসন ভেঙে ফিরে এসে কুড়িয়ে নিলেন ‘ভারতের মেরিল স্ট্রিপ’-এর ‘খেতাব’। ২০১৭ সালে সর্বশেষ তাকে ‘মম’ সিনেমায় দেখা গেছে। শেষ ছবিটি মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত আর রইলেন না। শাহরুখের ‘জিরো’র শ্যুটিং শেষ করে গিয়েছেন। সেই শূন্যেই শেষ হল শ্রীদেবীর অভিনয় জীবন।
একসময় পর্দায় শ্রীদেবীর উপস্থিতিতে বিবর্ণ হয়ে যেতেন সহশিল্পীরা। ভারতের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত অভিনেত্রীকে বলা হয় তিনি বলিউডের নারী অমিতাভ বচ্চন। ১৯৯৩ সালের কথা, সেসময় জুরাসিক পার্ক ছবিটি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন হলিউড নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ। শ্রীদেবীর সুনাম শুনেছিলেন তিনিও। এ ছবিতে শ্রীদেবীকে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। শ্রীদেবী তখন বলিউডের বিগ বাজেটের ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। সব মিলিয়ে কেরিয়ারের সোনালি সময় পার করছিলেন। সে দিন স্পিলবার্গের এমন প্রস্তাব খুব একটা মনঃপূত হয়নি। দ্বিধাহীনভাবেই স্টিভেন স্পিলবার্গকে না বলে দিয়েছিলেন।
শ্রীদেবী মানে কেবল সিনেমা বা অভিনয় নয়। তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন এক আইকন। ক্লাসরুমে অঙ্ক খাতার মাঝে তার ছবি। শুধু ছেলেরা নয়! তার মতো হলদে বা নীল বা আশমানি শাড়ি হাওয়ায় না ওড়ালে নিজেদের সুন্দর মনে করত না আমাদের দেশের অনেক মেয়ে। উষ্ণতার রোমান্টিক গন্ধ, আবেদন তার অন স্ক্রিন উপস্থিতিতেই ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্বে।
শ্রীদেবী শুধু রোমান্টিসিজমকে জাগিয়ে রাখলেন তা নয়। তার সঙ্গে এল স্ক্যান্ডাল! মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে তার চুপিচুপি বিয়ের কথা আজও সিনেমাজগতে আলোচনার বিষয়!
১৯৯৬ সালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক বনি কাপুরকে বিয়ে করেন। তাদের দুই মেয়ে জাহ্নভি এবং খুশি।
‘ইংলিশ ভিংলিশ’-এর শশীর মতোই জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন শ্রীদেবী। পাপারাৎজির দল তাকে ঘিরে ধরলেও তিনি কোনও দিন ইন্ডাস্ট্রিকে ঘিরে মন্তব্য, ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে মুখ খোলেননি। এমনকি সাক্ষাৎকার দিতেও পছন্দ করতেন না।
শ্রীদেবীর চোখে এক অদ্ভুত চমক ছিল। কথিত আছে, কোন শট দেওয়ার আগে নাকি তিনি চোখ বন্ধ করে থাকতেন। শট শুরু হলেই চোখ খুলতেন। আর তখনই এক অসম্ভব চমক ঔজ্জ্বল্য ছিটকে বের হয়ে আসত তার চোখ থেকে। সেই চমকটা নিয়েই তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি নতুন করে কাজ শুরু করেছিলেন। তার থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়ার বাকি ছিল। কিন্তু ছোট গল্পের মতো অসম্পূর্ণই রয়ে গেল এই কাহিনি। হয়তো এভাবেই তিনি চলে যেতে চেয়েছিলেন। একা এবং আকস্মিক মৃত্যুর মধ্যে ছেদ ঘটলে রঙিন জীবনের। অকালে ঝরে গেল এক নক্ষত্র। নক্ষত্রের মত তার জীবন ও হৃদয়। ফাল্গুনে অবেলায় ঝরে পড়ে গেল। তবু জীবন অগাধ। কবির ভাষায় বলতে হয়: ‘তোমারে রাখিবে ধরে পৃথিবীর আলো রাত যত!’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)