‘আজি এ শ্রাবণ দিনে চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ ঐ আকাশ পানে; যেন ছল ছল আঁখি ডানা ভাঙা পাখি, পারবে কী নিতে পথ চিনে?’ প্রকৃতিতে এখন চলছে বর্ষা ঋতু। মেঘ-বৃষ্টি-বর্ষা, কাদা, মধ্যবিত্ত নাগরিকের বর্ষার গান, স্বপ্নের জালবোনা, খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট, গরিবের ফুটো চাল বেয়ে বৃষ্টির জল পড়ার দুর্ভোগ।
এবার এই বর্ষার উদাস করা ঋতুতে আকস্মিক বসন্তের ঢেউ জেগেছে। সেই বসন্ত- যা জীবনকে রাঙিয়ে দেওয়ার ঋতু। ফুল ফুটবার, পাখি ডাকার ঋতু। অধিকারের ঋতুও হয়তো। মানুষের জীবনে অবশ্য বসন্ত কারণে-অকারণে, সময়ে-অসময়ে হানা দেয়। এমনকি ফুল ফুটলেও, না ফুটলেও বসন্ত আসে, আসতে পারে। বসন্তের আগমনের তাই কোনো নিয়ম-নীতি নেই। যখন তখন তা আসতে পারে আমাদের দুয়ারে। এটা সম্ভবত বসন্তের অধিকার। সেই অধিকারের দাবি নিয়েই এবার ভরা বর্ষায় আকস্মিক বসন্তের আগমন ঘটেছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে।
রাজধানী জুড়ে যেন বসন্ত-বাতাস আছড়ে পড়েছে। হাজার হাজার লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী ঢাকার রাস্তায় প্রজাপতির রঙে নেমে পড়ে। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয় তারা। পুলিশের গাড়ি, মন্ত্রীর গাড়ি, আমলা-সেনা, বিচারক, গণমাধ্যমকর্মী, সাধারণ-অসাধারণ সবার গাড়ি তাদের নির্দেশ অনুযায়ী চলতে বাধ্য হয়।
শিশু শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের অভিভাবক, পরিচালক। তারা অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যেক যানবাহনের কাগজপত্রের বৈধতা পরীক্ষা করে। কাগজপত্রে ঝামেলা থাকলে গাড়ির গায়ে লিখে দেওয়া হয় অবৈধতার কথা। তারা আলাদা আলাদা লেন করে সব গাড়ি চলতে বাধ্য করেছে। অনিয়মের রাজত্বে হঠাৎ-ই নিয়মের শাসন। জোর নয়, সম্মতি ও নৈতিকতাকে ভিত্তি করে শিশুকিশোররা বাংলাদেশে এমন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
এমন পরিস্থিতি কিন্তু এমনি এমনি তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের অবহেলা, অনিয়ম, আর উপেক্ষার কারণে তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। সংশ্লিষ্টরা আইন-কানুনের ধার ধারেন না। দুর্নীতি আর কায়েমী স্বার্থের দাসত্ব মেনে নেবার কারণে প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা ও ক্ষোভ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বেপরোয়া গাড়ি চালনা, বাসে বাসে প্রতিযোগিতা, রেষারেষি করে একটাকে কাটিয়ে আরেকটার সামনে এগুনোর চেষ্টা, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, অবৈধভাবে লাইসেন্স-পারমিট প্রদান, ইউনিয়নবাজি, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা— ইত্যাদি বহুবিধ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছিল।
এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা। সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। সারাদেশ ফুঁসে উঠছিল, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়, এ সব আসলে ‘হত্যাকাণ্ড’। নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে কারও বেপরোয়া আচরণ, কারও কর্তব্যে অবহেলা— এর জেরেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে, একের পর এক মৃত্যু নেমে আসছে। এসব নিয়ে সচেতন মহলে, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-সেমিনারে, গণমাধ্যমে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কেউ তাতে গা-করেনি। ফলে অসহায় মানুষ কেবলই ক্ষুব্ধ হচ্ছিল। সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এক অভূতপূর্ব এবং অসাধারণ ভঙ্গিতে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ক্লাসরুম ছেড়ে ঢাকার রাজপথে যান নিয়ন্ত্রণের ভার দখল করে নেয়। শুধু যান নিয়ন্ত্রণের ভার কেড়ে নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তাদের তৎপরতা। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে যান চলাচলের ব্যবস্থা যে চরম বিশৃঙ্খলার শহর ঢাকাতেও সম্ভব, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের মোকবিলাও যে অত্যন্ত কড়া হাতে করা সম্ভব, প্রশাসনের গালে থাপ্পড় দিয়ে সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে ও দেখিয়ে দিয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।
নিজেদের বোধ-বুদ্ধি-বিবেকের শ্রেষ্ঠতম প্রয়োগ ঘটিয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছে ব্যস্ততম ঢাকার রাজপথেও আপৎকালীন পরিষেবার জন্য এমারজেন্সি লেন তৈরি রাখা সম্ভব। যে লেন ধরে মুমূর্ষু রোগীবাহী এম্বুলেন্স সবেগে চলবে হাসপাতালের দিকে।
শিশুশিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, কর্তব্যনিষ্ঠা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার ‘হাতে-কলমের শিক্ষা’ দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়েছে। ‘বুড়োধাড়ি’দের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও অক্ষমতার ক্যানভাসে শিশুদের এমন রাষ্ট্রনায়কোচিত রূপ দেখে আবেগের আতিশয্যে অনেকের চোখে জলও এসেছে। সবাই হাত তুলে এমন সোনার-সন্তানদের আশীর্বাদ করেছে। এই শিশুদের মধ্যে শোষণ-বঞ্চনাক্লিষ্ট মানুষ আশার স্বপ্ন দেখতে পেয়েছে।
প্রায় সপ্তাহকাল ধরে দেশবাসী হঠাৎ-বসন্তে ফুটে ওঠা এই কুঁড়িদের সৌন্দর্য-সুবাসে আকুল হয়েছে। তৃপ্তির আবেশে ব্যাকুল হয়েছে। প্রশংসা, আর সাব্বাসি এসেছে সমাজের নানা মহল থেকে। তবে নিন্দা আর সমালোচনাও শোনা গেছে কোনো কোনো মহল থেকে। শিশুদের এই আকস্মিক জেগে উঠায় যাদের গালে থাপ্পড় পড়েছে, তারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেনি।
দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনের গতিপথও বদলে যায়। শিশুরা পড়তে চায়, মরতে নয়, এই দাবি আরও অনেক কিছুর সঙ্গে মিশে যায়। সিস্টেম বা ব্যবস্থা বদলের কথাও ক্রমে শিক্ষার্থীদের প্ল্যাকার্ডে শোভা পায়। এই আন্দোলন শিশুদের কাছে একটা পবিত্র আবেগের বিষয়ে পরিণত হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, শিক্ষার্থীদের এই আবেগ সবার কাছে সমান মর্যাদা পায়নি।
একথা ঠিক যে, নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার এই অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনকে কেউ সমর্থন করুন বা না করুন, অবজ্ঞা কেউ করতে পারেননি। এই আন্দোলন বাংলাদেশের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল না শাসন কাঠামো বদলে দেওয়া বা সরকার ফেলে দেওয়া, উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসন তথা সরকারের টনক নড়ানো, তা নড়েছে।
গত কয়েক বছর ধরে যে খসড়া সড়ক নিরাপত্তা আইন টেবিলে টেবিলে উদ্বাস্তুর মত ঘুরছিল, সাতদিনের মাথায় তা মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে!
বর্ষায় ‘বসন্ত’ হিসেবে আবির্ভুত এই ছাত্র-আন্দোলন বাংলাদেশের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। এই আন্দোলনটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। যে নতুন প্রজন্মকে পুরনোরা অবজ্ঞা-উপেক্ষা করে এসেছে, তাদের এখন নতুন ভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এই প্রজন্ম স্মার্টফোন নির্ভর, ‘ফার্মের মুরগি’ ফেসবুক, হোয়াটস-আপ, টুইটার, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও গেম, ইন্টারনেট-ক্রিকেটে বুঁদ হতে হতে এই প্রজন্ম বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে এবং সামাজিকতা থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। সেই প্রজন্মই দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়ার ভূমিকাও পালন করতে পারে তারা। অতঃএব অত্যন্ত ইতিবাচক একটা ছবি তৈরি করেছে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বুকে হঠাৎ জেগে ওঠা তারুণ্যের এই উত্তাল আন্দোলন এও বুঝিয়ে দিল যে, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের প্রতি এক ব্যাপক অনাস্থা তৈরি হয়েছে জনসংখ্যার বড় অংশের মধ্যে। সেই তীব্র অসন্তোষের প্রতিনিধি হয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে তরুণ-তরুণীদের। যে প্রজন্ম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের প্রতি সেই প্রজন্মের অনাস্থা তৈরি হওয়া রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক ইঙ্গিত। রাষ্ট্রের কাণ্ডারিরা যদি তা বুঝতে পারেন, রাষ্ট্রের গলদগুলো সারানোর উদ্যোগ নেন, তাহলে মঙ্গল, আর তা না হলে ভবিষ্যতে চড়া মূল্য দিতে হবে।
যদিও শিক্ষার্থীদের এই নজিরবিহীন আন্দোলনকে ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি নেপথ্যে কোনও কায়েমি স্বার্থের উস্কানি রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নানা মতের এই দেশে এটা কোনো নতুন কিছু নয়। বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশাসনের বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই আন্দোলনে। বাংলাদেশের শাসককুলকে এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা অনুধাবন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই শিশুরা রাজপথ চিনে গেছে। আপাতত তারা ক্লাসরুমে ফিরে গেলেও ধারাবাহিক অন্যায় তাদেরকে আবারও রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য করবে।
পাদটিকা: শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল, তাদের আবেগকে শাসকরা মূল্য দেবে। শ্রদ্ধা দেখাবে। কিন্তু শাসকদের পক্ষ থেকে তা না করায় তারা অভিমানী হয়েছে। তারা অনিচ্ছায় রাজপথে থেকে দেখতে চেয়েছে, সেই অভিমান ভাঙ্গাতে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এগিয়ে আসে কি না! কিন্তু না, শাসকরা শিক্ষার্থীদের এই আবেগ আর অভিমানের মূল্য দেয় নি। বরং চেনা দুর্বৃত্তদের অচেনা মুখোশ পরিয়ে শক্তি দিয়ে দমন করতে চেয়েছে শিক্ষার্থীদের রাজপথের আন্দোলন। ‘বৈশাখী ঝড়ে’ লণ্ড-ভণ্ড করে ফেলা হয়েছে বসন্তের বাহারি ফুল!
তবে শাসকদের সতর্ক ও সংযত হওয়ার সময় এসেছে। তারা যদি আচরণ না পালটান তবে এমন ‘বসন্ত’ আবার আসবে। বসন্ত কিন্তু ফিরে ফিরে আসে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)