টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের কারখানায় বয়লার অথবা গ্যাসরুমে বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ২৬ জন। গুরুতর আহত আরও অর্ধশতাধিক শ্রমিক। সারাদিন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি রক্ত-মাংস-হাড় আর কালো কালো লাশ। তিন তলা ভবনটি একটা স্যান্ডউইচে পরিণত হয়েছে। এই স্যান্ডউইচের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে লাল লাল রক্ত, কালো কালো মাংস আর সাদা সাদা হাড়-গোড়। কোনটা কোন মানুষের লাশ সেটা সনাক্ত করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কি ভয়াবহ একটা ব্যাপার একবার চিন্তা করুন।
আচ্ছা এই ভয়াবহ ব্যাপারটা কি এই প্রথম দেখছি আমরা?
রানা প্লাজার কথা কি আমরা ভুলে গেছি? ভুলে তো যাই নাই। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গার্মেন্টস কলাপস। ১,১২৯ জনের মৃত্যু, প্রায় ২,৫০০ আহত। দুই মাস ধরে কেবল লাশের খোঁজই চললো। পুরো এক বছর সেই এলাকার মানুষ মুখে রুমাল দিয়ে ঘুরেছে। লাশের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকতো। স্রেফ পিলারের নিচে চাপা পড়ে এক হাজারের বেশি মানুষ মরে গেলো, ভাবা যায়? যেই আড়াই হাজার বেঁচে গেছেন, তাদের অধিকাংশের শারীরিক অবস্থা এমন যে ভিক্ষা করেও খেতে পারেন না।
আচ্ছা আমরা কি তাজরিন ফ্যাশনের কথা ভুলে গেছি? ভুলে তো যাই নাই। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর, স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ড। ১১৭ জন মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যায়, ২০০ মানুষ আহত হয়। আমরা শুনেছি মেশিন বাঁচানোর জন্য এক্সিট পয়েন্টের তালাটা খোলা হয়নি। মানুষ পুড়ে কাবাব হয়েছে, মেশিন বহাল তবিয়তেই বেঁচে বর্তে আছে।
২.
ঘটনা তিনটাতে একটা জিনিস কমন সেটা হচ্ছে যারা মারা গিয়েছে তাদের সবাই শ্রমিক। আসলে সত্যি বলতে শ্রমিকেরা এখনো ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি, তাদের জন্য আমাদের ঠিক ততোটা পোড়ে না। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহৎ ট্র্যাজেডি। প্রথমটা টুইন টাওয়ার। টুইন টাওয়ারের ঘা এখনো দগদগে আর রানা প্লাজার ঘা শুকিয়ে গিয়েছে আরও বহু আগে। একবার ভেবে দেখুন তো আজকে যদি কার্জন হল ভেঙ্গে পড়তো, হাইকোর্ট ভবন কিংবা গণভবন ধসে পড়তো, মতিঝিলের একটা ব্যস্ত ব্যাংক-ভবন ধসে পড়তো, হাজার নয় মোটে একশো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়কর্তা মারা পড়তো তাহলে তাদের আমরা কি ভুলে যেতাম? ঠিকই মনে রাখতাম। আসলে এরা তো শ্রমিক, আমাদের এলিট মস্তকের নিউরনে এরা কেবল একটা নিউজ হেডলাইন হয়েই থেকে যাবে।
কেন এমন হচ্ছে?
টেক্সটাইল ক্ষেত্রের কথা যদি ধরি। এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ। আমেরিকায় গার্মেন্টস শ্রমিকের দাম বেশি? সবচেয়ে কম দামের শ্রমের দেশ থেকে কাপড় বানিয়ে আনতে হবে। এটা তো একদিক দিয়ে আমাদের জন্য ভালো। লক্ষ-লক্ষ মানুষের খাওয়াপরার ব্যবস্থা। হত-দরিদ্র কর্মহীন মানুষদের কাজের সুযোগ। একা গার্মেন্টস শিল্পই দেশটাকে রাতারাতি বদলে দিতে পারতো। কিন্তু ব্যবসা যত ভালোই হোক, শিল্প যতই সমৃদ্ধ হোক কাজটা জানতে হয়, বুঝতে হয়। কম শ্রম মূল্যে যে কোনো রমরমা গরম ব্যবসা আমাদের অদক্ষ পুঁজিপতিদের এই সমস্ত শিল্পে বিনিয়োগ করার আগ্রহকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে। যে যেভাবে পেরেছে গার্মেন্টস, ফেব্রিক, ডাইং ইন্ডাস্ট্রি খুলে বসে আছে। এক ছাদের নিচে হাজার হাজার মানুষ বসিয়ে ফ্যাক্টরি চালু করে দিয়েছে। তাদের না আছে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা, না আছে কোনো টেকনিক্যাল জ্ঞান।
আমি একজন বস্ত্র প্রকৌশলী হিসেবে বলতে পারি আমাদের বেশির ভাগ ফ্যাক্টরিগুলোতে দক্ষ এবং টেকনিক্যাল জ্ঞান বিশিষ্ট টেকনিশিয়ানদের রয়েছে ভয়াবহ অভাব। টেক্সটাইল এমন একটা সেক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে ঐ বিষয়ের বাইরের মানুষদের দাপট আর জয়জয়কারে সবকিছু একাকার হয়ে গেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলে নেয়া যায় তাজরিন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ নৃবিজ্ঞানী শ্বেত-পত্র প্রকাশ করে। সেই শ্বেত-পত্র থেকে কিছু লাইন উল্লেখ করছি প্রসঙ্গক্রমে।
এখানে একজন শ্রমিক কথা বলছেন- ‘২৪শে নভেম্বর যেদিন আগুন লেগেছিল, ফায়ার এ্যালার্ম বাজার পরে ছয়তলার একজন শ্রমিক সিঁড়ির কাছে আসলে, প্রোডাকশন ম্যানেজারকে বিড়ি ফুঁকতে দেখেন। শ্রমিকটির প্রশ্ন, ‘ফ্যাক্টরির ভিতরে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ভয়ে কখনোই ফ্যাক্টরির ভিতরে সিগারেট খায় না। কিন্তু পি.এম স্যার তখন সিগারেট খাচ্ছিলেন। এই সিগারেট থেকেই যে আগুন লাগে নাই কিভাবে জানি?’
একই ভাবে রানা প্লাজাকেও ধ্বসে পড়ার আশংকা আগেই জানানো হয়েছিলো। হয়তো আগামীকাল ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের ক্ষেত্রেও একই রকম কোনো খবর পাওয়া যাবে, কিন্তু আমলে কে নেবে? যার আমলে নেয়ার কথা তার কি সেটা বোঝার ক্ষমতা আছে? টাকা দিয়ে তো আর ‘বোঝার ক্ষমতা’ কিনে ফেলা যায় না। কথা হচ্ছে এটা তো শেষ ঘটনা নয়, এরকম আরও ঘটবে সেই বন্ধ করার জন্য আমরা কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছি না। কেন নিতে পারছি না? কারণ টাকা। ফ্যাক্টরি মালিকদের অনেক অনেক টাকা। তাদের ওপর চাইলেই কোনো নিয়ম বসিয়ে দেয়া যায় না, কারণ তাদের টাকা আছে।
এতগুলো বড় বড় ঘটনা ঘটার পরেও আমরা এই সমস্ত ফ্যাক্টরি মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারার অন্যতম আরেকটা কারণ আমাদের শ্রম আইন। যতদূর জানি আমাদের শ্রম আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। রানা প্লাজার জুয়েল রানারই কিছু হলো না আর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে তো মাত্র ৩০ জন। আমাদের ভুলে যেতে বড়জোর ৪৮ ঘণ্টা লাগবে।
সরকারের কাছে নিবেদন, আর কিছু করতে না পারুন শ্রম আইনটা একটু সংশোধন করুন। শ্রমিকের জীবনের মূল্য নাই কিন্তু শ্রমিকের টাকাতেই দেশ চলে। এভাবে মরতে থাকলে খুব বেশিদিন তারা আর চুপ করে থাকবে বলে মনে হয় না। বিশ হাজার টাকা দিয়ে শ্রমিক ঠাণ্ডা করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে ব্যাপারগুলো আমলে নিন, প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল মানুষজন নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করুন। বুঝতে হবে একটা অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র থাকলেই, এক্সিট সিঁড়ি থাকলেই, ফ্যাক্টরির সামনে লাল দাগে ‘সমবেত হবার স্থান’ লেখা থাকলেই, আর বিল্ডিং ক্লিয়ারেন্স থাকলেই আপনি নিরাপদ নন, এসব ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের দক্ষতাও থাকা চাই। সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই না মানুষ গুলো পুড়ে পুড়ে আপনাদের এভাবে আর বিব্রত করে তুলবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)