চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শেখ হাসিনা ও বিশ্বশান্তি

১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে ৫১টি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘ। সমগ্র বিশ্বব্যাপি বিস্তৃত কর্মপরিধির এই বিশ্বসংস্থার বর্তমান সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯২। জাতিসংঘ সনদের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ এবং এতদুদ্দেশ্যে শান্তিভঙ্গের হুমকি নিবারণ ও দূরীকরণের জন্য এবং আক্রমণ অথবা অন্যান্য শান্তিভঙ্গকর কার্যকলাপ দমনের জন্য কার্যকর যৌথ কর্মপন্থা গ্রহণ, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক বিরোধ বা আইনের নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আন্তর্জাতিক বিরোধ বা শান্তিভঙ্গের আশঙ্কাপূর্ণ পরিস্থিতির নিষ্পত্তি বা সমাধান; বিভিন্ন জাতির মধ্যে সমঅধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ নীতির ভিত্তিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রসার এবং বিশ্বশান্তি দৃঢ় করার জন্য অন্যান্য উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ; অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা মানবিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিকাশ সাধন এবং মানবিক অধিকার ও জাতিগোষ্ঠী, স্ত্রী-পুরুষ, ভাষা বা ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মৌল অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে উৎসাহ দান।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার যে অনুপম সৌধের উপরে এই বিশ্বসংস্থার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল বিশ্বের দিকে দিকে তার বাস্তবায়নে আজ তা চরমভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

আমরা আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালন করি। কিন্তু বাস্তবে শান্তির বড় অভাব। পরিবারে, সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে এমনকি প্রতিবেশী দেশসমূহে সর্বত্রই প্রত্যাশিত শান্তির উপস্থিতি বিরল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে মরুময় আরব ভূখণ্ডে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি অশান্তি বিরাজিত ছিল। আর তা নিরসনের তরে ধুলির ধরায় শুভাগমন করেছিলেন বিশ্বের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব; ঐশী নির্দেশনার আলোকে সর্বোন্নত জীবনাদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমাজে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শান্তির পরশ। ইতিহাসের ক্রমধারায় পৃথিবীর নানান জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে অজস্র মনীষীর আগমন ঘটেছে। সমাজ কখনো শান্তির মুখ দেখেছে আবার কখনো সমাজদেহের শান্তি তিরোহিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে বিশ্ব-নেতৃত্বের যোগ্যতা, দক্ষতা আর শতভাগ আন্তরিকতা নিয়ে যারা স্বদেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলস কর্মপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের অন্যতম।

তিন বছরের শিশু আইলানের সমুদ্র তীরে মৃত পড়ে থাকার দৃশ্য কিংবা আলেপ্পোয় রক্তমাখা নিস্তব্ধ শিশু ওমরান আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন এক মমতাময়ী মা হিসেবে তার বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন তার পরিবারের বন্দীত্ব এবং ১৯৭৫-এ জাতির পিতার সপরিবারে নির্মম শাহাদত বরণ তাকে সর্বদাই শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাড়িত করে। উদ্বাস্তু আর শরণার্থীদের জন্যে তার হৃদয় কেঁদে ওঠে, কেননা ১৯৭৫ হতে ১৯৮১ সাল পযর্ন্ত ৬ বছর ছোট বোনসহ বিদেশে শরণার্থী থেকে তিনি তার জীবনে পৃথিবীর তাবত শরণার্থীর বেদনার বাস্তবতা উপলব্ধি করেন। দেশরত্ন শেখ হাসিনা বহুদিন যাবত বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সমাজে কাঙ্খিত শান্তি প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। তাই শতবর্ষ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (millennium development goals) সামনে রেখে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এমন ছয়টি পরস্পর ক্রিয়াশীল বিষয়যুক্ত একটি মডেল তিনি জাতিসংঘের ৬৬তম অধিবেশনে উপস্থাপন করেন। বিষয় ছয়টি হল ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণ, বৈষম্য বা অসমতা হ্রাসকরণ, বঞ্চনা লাঘব, পিছিয়ে পড়া জনগণকে সমাজের মূল ধারায় অন্তর্ভূক্তিকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ ও সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ শান্তির মডেলকে সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার অভিপ্রায়ে পৃথিবীর ছয় মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, অর্থনৈতিক সংস্থা, আইনবিষয়ক সংগঠন, ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক ও সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে ইতোমধ্যেই বেশ ক’টি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে শান্তির জন্য উত্থাপিত এ মডেলটি গোটা দুনিয়াব্যাপী গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিক থেকে এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। মানবতার সামগ্রিক কল্যাণে এটি আজ শান্তিদর্শনে রূপলাভ করেছে। অবিচারমুক্ত শান্তিপূর্ণ সমাজকে সমৃদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেবে চিহ্নিত করে জাতিসংঘ অধিবেশনের মূল প্রতিপাদ্য ‘আন্তর্জাতিক বিরোধ নিরসনে শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতা’ বিষয়টিকে সামনে রেখে এ মডেল উপস্থাপিত হয়েছে।

যুদ্ধবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত নম্বর ৩৬/৩৭ প্রস্তাব অনুসারে প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ৫৫/২৮২ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ হিসেবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেমতে, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিশ্বের সকল দেশ ও সংগঠন কর্তৃক যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে শেখ হাসিনা তাঁর মমতাময়ী হৃদয়, মানবতাবাদী আদর্শ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধি করলেন শুধুমাত্র দিবস পালন করলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না; সেজন্য প্রয়োজন নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা। তাই তিনি ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’-এর তিনদিনের মাথায় উত্থাপন করেন বিশ্বশান্তির মডেল; যার সফল বাস্তবায়নে গড়ে ওঠবে সেই মানবিক ও সমৃদ্ধ বিশ্বব্যবস্থা। সাতশ’ কোটি মানুষের এই পৃথিবীকে পাল্টে দিতে এটি শেখ হাসিনার শান্তিকেন্দ্রিক উন্নয়নের নতুন মডেল; যার মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্ম সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এই মডেলের মূল বিষয় হচ্ছে সকল মানুষকে সমান চোখে দেখা এবং মানবিক সামর্থ উন্নয়নের কাজে লাগানো। বস্তুত অর্থে বিশ্বশান্তি আন্দোলনে বাংলাদেশ শান্তির মডেল উত্থাপনের মাধ্যমে নেতৃত্বের শীর্ষে অবস্থান করছে। এছাড়া জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সর্বাধিক শান্তিসেনার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পৃথিবীর নানান দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এদেশের শতাধিক শান্তিসেনা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে বিরল আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এমনই এক সময়ে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে উচ্চকিত বিশ্বশান্তির মডেল খুবই গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। সেজন্যই আমরা দেখতে পাই, জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের মডেল (peoples empowerment and development model) শিরোনামে শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির মডেলটি ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের সবারই সমর্থন লাভ করে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে এ মোমেন বলেন ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাধারা বিশ্বশান্তির মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে; এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। সবচেয়ে বড় কথা, একটি রাষ্ট্রও এর বিরোধিতা করেনি’।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন (জন্ম-১৯৪৪ খ্রি.) বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল (model of economic development) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল ও নিউইয়র্ক টাইমসসহ পৃথিবীর বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য উৎপাদন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কাণ্ডারি শেখ হাসিনা উত্থাপিত বিশ্বশান্তির মডেলকে মূল্যায়ন করে বলা হয়েছে। ‘Her emphasis on human rights, education, constitutional rights and rights to get justice are indeed relevant to achieve peace’ বিশ্বশান্তির মডেলে উপস্থাপিত বিষয়াবলিতে শেখ হাসিনার মূল্যবান দিকনির্দেশনায় মানব উন্নয়ন, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণ, আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে অসমতা হ্রাসকরণ, বঞ্চনা লাঘব, পিছিয়ে পড়া জনগণকে মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা, সকলের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সন্ত্রাসবাদের অবসান সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সব বিষয়ই বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধময় সমাজ বিনির্মাণে এসবের বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

ইইউ২০১৭ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত ‘আরব ইসলামিক আমেরিকান সামিট’-এ অংশ নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরলেন বিশ্বে শান্তি স্থাপনে তার চারটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্রাম্প ও মুসলিম প্রধান অর্ধশতাধিক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান। তাদের সামনে শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করতে হবে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে, মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি দুর করতে হবে আর সংলাপের মধ্য দিয়ে আসবে বিশ্বশান্তি। আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলন আয়োজন করেছে সৌদি আরব। আর সে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্ব ফোরামে বিশ্বনেতার মতোই এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

সর্বশেষ তিনি মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আসছে তাদের প্রতি মানবিক আচরণের নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং তার সরকার এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে তৎপর করতে সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। এছাড়া ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, দেশের জনগণের সামনে একটি ভিশন তথা অভীষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরা এবং সন্ত্রাস দমনে তাঁর ভূমিকা এতদঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)