“দিল্লি অফিসের লম্বা বারান্দায় ‘র’ এর প্রধান কাউ বসে আছেন। হাতে চায়ের মগ । দার্জিলিং এর চা, দুধ চিনি ছাড়া। ভেতরে তিনটা তুলসী পাতা ভাসছে”
শেখ সাদীর ১৫ আগষ্টের ১০০ মিনিট উপন্যাসের হুবহু তিনটি লাইন। এই তিনটি লাইন ধরেই আলোচনাটা শুরু করতে চাই। কারণ আমার ব্যাক্তিগত মত, এই তিনটি লাইনের মধ্যে বলা আছে গোটা উপন্যাসটির ধরণ।
গল্পটা যে সময়ের সে সময় ‘র’ এর প্রধান কাউই ছিলেন সন্দেহ নেই। ষাটোর্ধ এক জন মানুষ দুধ চিনি ছাড়া চা পান করবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্ত সেই চায়ের মগে তুলসী পাতা ভাসবে কী ভাসবে না এর সঙ্গে ইতিহাস বা সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। যদিও লেখকের কল্পনায় কাউ এর চায়ের মগে তুলসী পাতা ভেসেছে অবলীলায়। কিন্তু এতে ইতিহাসের কোন ক্ষতি হয়েছে মনে হয়নি, বরং ইতিহাসের কাউ চরিত্রটি আরো সজিব হয়েছে পাঠকের কাছে। যে কেউ ভাবতেই পারেন “এখনই কথা বলে উঠবেন কাউ”।
শেখ সাদীর এই উপন্যাসটি আর ১০টা উপন্যাসের মত নয়। কারণ এখানে পাঠকের সামনে কিছু অপরিচিত চরিত্র কিছু অপরিচিত ঘটনার মালা গাঁথে না। এখানকার প্রায় প্রতিটি চরিত্র সবার চেনা। কেউ কেউ যদি একটু অচেনাও হন, তিনি কাল্পনিক চরিত্র নন, বরং লেখক চেষ্টা করেছেন একটি সত্য ঘটনার আড়ালে দীর্ঘ দিন লুকিয়ে থাকা কিছু চরিত্রকে আলোয় নিয়ে আসার।
তবে হ্যাঁ , এখানে সুমন নামে একজন সত্যান্বেষীর কাল্পনিক চরিত্র আছে। গোটা উপন্যাসটিই যার চিন্তার বর্ননা। হোসনে আরার’র মত আরো দু’একটি কাল্পনিক চরিত্র উপন্যাসে এসেছে সুমনের স্বাভাবিক চিন্তায় সহায়তা করতে। আর এই সুমনই চেনা অচেনা সবাইকে নিয়ে হেঁটেছেন একটি অতিচেনা ঘটনার মানচিত্র জুড়ে। ঘটনাটি আর কিছু নয়, ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ড। উপন্যাসের নাম ১৫ই আগস্টের ১০০ মিনিট। কিন্তু পটভূমি শুরু ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই।
উপন্যাসের ধরণ বিবেচনায় এটি একটি ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস। কিন্তু উপন্যাসের পাশাপাশি লেখাটিকে আমি বলতে চাই এটি একটি বড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও। বিষয়টি পাঠকের কাছে যেন খটোমটো না হয় সে জন্যে উপন্যাসের ছাঁচে ফেলেছেন লেখক। কিন্তু কাজটি যে তিনি জোর করে করেছেন তা নয়।
সুমন নামের যে চরিত্রটি একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুঃসহ স্মৃতীতে ভারাক্রান্ত। এই চরিত্রটিও আমাদের সবার চেনা। বলা যায় যেকোন সভ্য সচেতন মানুষ এই চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে গুলিয়ে ফেলতে পারেন । উপন্যাস পড়তে পড়তে যে কারো মনে হতেই পারে “ এ তো আমার কথা, আমিও এরকম করেই বলতে চেয়েছিলাম বা চাই”। তাই আমি বলবো, সময়ের প্রয়োজনে উপন্যাসের একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে এই লেখার মধ্যদিয়ে। তথ্য চিত্র নির্মাণের “ডকু ড্রামা” ধারার সঙ্গে এর তুলনা চলে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে নানা ধোঁয়াশা ছিল আমার নিজের মধ্যেও । মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার , সরকারের বিরোধিতা , সরকারের নানা দুর্বলতা , দুর্বলতার কারণ খুব পরিস্কার ভাবে উঠে এসেছে ১৫ই আগস্টের ১০০ মিনিটে। বিচ্ছিন্ন ভাবে এসব বিষয় নিয়ে হাটে মাঠে ঘাটে শুনছি, পড়ছি দীর্ঘ দিন। সে সবই মাঠের বক্তৃতা। অর্থাৎ বলার জন্যেই বলা। যেখানে কোন জোরালো যুক্তি নেই।
যেমন ধরা যাক আমরা তো সব সময়ই শুনি “বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে বিদেশি চক্রান্ত ছিল” কিন্তু দালিলিক প্রমাণ দিয়ে বলেছেন ক’জন ? শেখ সাদীর উপন্যাস থেকেই জানলাম কী ভাবে হলান্ড থেকে পিটার জোসেফ মারিয়া কাসটারাস নামে এক যুবক ত্রাণ কর্মীর ছদ্দবেশে ঢাকায় এসেছিল। কীভাবে সে সারাদেশে সরকার বিরোধী নাশকতা ছড়াচ্ছিল। এখানেই জানা গেলো কীভাবে ধরা পড়লো কাসটারাস এবং তাকে ফেরত পাঠানো হলো । তার ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দির বরাত দিয়েই এসব তথ্য উপন্যাসে যুক্ত করেছেন লেখক।
উপন্যাসে তথ্য উপাত্ত দিয়েই জাসদ গণবাহিনী ভূমিকার কথা বলা আছে। বলা আছে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য করার অপরাধে কী ভাবে ১৯৭৪ এ গোটা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। ইতিহাস ঘৃনিত খন্দকার মোশতাক এই উপন্যাসে খুব পরিস্কার ভাবেই এসেছে পাঠকের সামনে । দফায় দফায় তার লোভের দালিলিক বিবরণ এসেছে এই লেখায়।
বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের প্রায় প্রত্যেক সদস্যের বিস্তারিত বর্ননা আছে উপন্যাসে। খুনি দলের নেতা ফারুক, রশীদ কী ভাবে ফুসছিল , কীভাবে লোকজন জড়ো করছিল , কার কার সমর্থন নেয়ার চেষ্টা করছিল, কোথায় না কোথায় গিয়েছিল সব তথ্যই যোগাড় করেছেন লেখক। মোদ্দা কথা শেখ সাদীর অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে রিসালদার মোসলেম থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, চৌএনলাই থেকে হেনরি কিসিঞ্জার।
তথ্য ঠাসা উপন্যাস কিন্তু তথ্য ভারাক্রান্ত নয় ১৫ই আগস্টের ১০০ মিনিট। একে সাহসী উচ্চারণ বললেও ভুল নেই। কারণ দলিল দস্তাবেজ দিয়ে এত গোয়েন্দা এত রাজনীতিকদের গোপন কাজ প্রকাশ করার ঝুঁকি তো আছেই। তাছাড়া এত তথ্য একত্রিত করা এবং সব তথ্যের শৈল্পিক সমন্বয়ের কাজটি করে প্রশংসার দাবি করতেই পারেন লেখক।
তবে উপন্যাসের বর্ণনায় কখনো কখনো বিবরণ আসলেও লেখক কোথাও তথ্য সূত্রের উল্লেখ করেননি। হয়তো উপন্যাসের আকারে তথ্য সাজিয়েছেন বলেই সেটার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, লেখার শেষে তথ্য সূত্রের উল্লেখ করে একটি পাতা যুক্ত করলে কোন কোন পাঠক স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তাহলে এটি উপন্যাসের কাঠামোতে বন্দি না থেকে হয়ে উঠতে পারতো নতুন কোন সত্য প্রকাশের দলিল।