এক নারী নেত্রীর সাথে সেদিন গিয়েছিলাম একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে। অফিস ম্যানেজারের সাথে ইনস্যুরেন্স পলিসি জানতে জানতে চা-নাস্তার পর্ব শেষ করে বিদায়লগ্নে ম্যানেজার তার বসের অফিস রুম দেখাতে নিয়ে গেল। রুমের দরজা বন্ধ দেখে আমি দেখার আগ্রহ দেখালাম না। কিন্তু ম্যানেজার সাহেব দেখাবে, তাই দরজা খুলে লাইটের আলো জ্বালিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল। অনেক বড় অফিস রুম। অনেক সুন্দর ও পরিপাটি। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে হঠাৎ থমকে দিয়েছে।
ছবি..! হ্যাঁ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রীতিমত এক প্রকার অযত্নে, খামখেয়ালি করেই পাশের দেয়ালে কোনো রকমভাবে টাঙানো! কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবি নেই! ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, বঙ্গবন্ধুর ছবি এভাবে অফিস কক্ষের এক পাশে কেন? আপনার বসের বসার উপরে অর্থাৎ মাথার উপরে দেয়ালে রাখতে পারতেন। সাথে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবিও। ম্যানেজার হেসে বললেন, আসলে এমনেই রাখা হয়েছে! তবে পাশের অন্য আরেকজন অফিস কর্মকর্তা বললেন, আসলে এটা তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তাই!
আমি জানি না, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ছবির টাঙালে কার কী সমস্যা বা ব্যবসার কী ক্ষতি হয়! তাও সম্মানের সাথে রাখলে, কার কী মাথা ব্যথা? কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, যার অফিস রুমে প্রবেশ করে আমি থমকে দাঁড়িয়েছি কিংবা ম্যানেজারকে প্রশ্ন করেছি, তিনি কিন্তু আওয়ামী লীগার। আওয়ামী লীগের কোনও একটি বিষয়ের সম্পাদকও। আমি খুব কৌতূহল নিয়ে ম্যানেজারকে আবারও প্রশ্ন করি, আপনার বস কি এগুলো দেখেই অফিস করেন? কিন্তু তার নীরবতায় আমার মনে আরও প্রশ্নের উদয় হয়…।
কথাটি বলেছি এই কারণে, আমরা গবেষণামুলক বা ইতিহাস চর্চার রাজনীতি করি না। রাজনীতি যখন ব্যবসার লাভ-ক্ষতির বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করাও কঠিন। ১৮ অক্টোবর চলে গেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন।
শেখ রাসেল নিয়ে আমাদের গবেষণামূলক তেমন কোনও গ্রন্থ আছে কিনা আমার জানা নেই। শেখ রাসেলের প্রিয় হাসু আপা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার (আমাদের ছোট রাসেল সোনা) স্মৃতিচারণ বইটিও আমরা এখনো আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। আবার গীতালি দাশগুপ্তা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পড়াকালীন ছাত্র রাসেলের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মজার কথাগুলোও আমরা আজও ডিজিটাল ডিভাইস আকারে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারিনি।
খুনিরা ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও নির্মমভাবে সপরিবারে শিশু রাসেলকেও হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বুলেটের আঘাতে একবারই হত্যা করেছে। কিন্তু শিশু রাসেলকে বুলেটের আঘাতে হত্যার করার আগেই কয়েকবার হত্যা করেছে। এগারো বছরের শিশু রাসেল আতঙ্কিত হয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’ বলে। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ড আর কোথাও ঘটেনি। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিতে নিতে শিশু রাসেলকে প্রতিটি লাশের সামনে মানসিকভাবেও খুন করেছে। একান্ত আপনজনের রক্তমাখা নীরব, নিথর দেহগুলোর পাশে নিয়ে গিয়ে শিশু রাসেলকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, জঘন্য কর্মকাণ্ডের দৃশ্যগুলো দেখিয়ে তাকে ভিতর থেকেও হত্যা করে সর্বশেষে বুলেটের নির্মম আঘাতে রাসেলের দেহ থেকে অবশিষ্ট প্রাণ ভোমরাটিকেও হত্যা করে খুনিরা।
শিশু রাসেল তার ১১ বছরের জীবদ্দশায় কেমন ছিলো, কীভাবে পড়াশোনা করতো, ভালো না লাগলে শিক্ষককে বারণ করা, প্রিয় শিক্ষককে ফোন করার বিষয়গুলো আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা জানে? শিশু রাসেলের জীবন গল্প আমাদের শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে আমরা কীভাবে উপস্থাপন করেছি কিংবা আদৌ করা সম্ভব হয়েছে? পাঠ্যপুস্তকে শিশু রাসেলের জীবনগল্প নিয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী তুলে ধরেছি?
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িতে শিশু রাসেল যখন জন্মগ্রহণ করে তখনকার পরিস্থিতি ছিল রীতিমত উত্তেজনক। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনাগুলো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। একদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল আবার অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও সম্মিলিত বিরোধী প্রার্থী কায়দে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। যখন কঠিন অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তখনই মুজিব-ফজিলাতুন নেছার ঘর আলোকিত করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু যার নাম রাখা হয় ‘রাসেল’।
সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল।’
আর এই রাসেল নামটিও রাখেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল। আর বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, বিজ্ঞানীও ছিলেন। পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও। আর বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্যে বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অব হানড্রেড’। মানুষের বসবাস যাতে সুন্দর ও শান্তিময় হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন বার্ট্রান্ড।
শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বাবা মুজিবকে ছাড়া। কারণ, বাবা মুজিব রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে ছিলেন দিনের পর দিন। আর চোখের সামনে বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে একপর্যায় ‘আব্বা’ বলেই সম্বোধন করতে লাগলেন। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি বাবা মুজিবও। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো।’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কী বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে’।
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের একুশ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’
ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে পরিবার একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন একজন আদর্শ মাতা। তিনি তার সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় মানুষ করেছেন, দিয়েছেন মানবিক গুণাবলিও। ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনার মাঝে অনুরূপ গুণাবলি প্রতীয়মান। তিনি তার সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা আর মানবিক গুণাবলি দিয়ে জয়-পুতুলকে গড়ে তুলেছেন। শিশু রাসেল বেঁচে থাকলে আজকের ৫৫ বছরের মানুষটিও হতেন এক অন্যন্য গুণাবলির ব্যক্তিত্ব। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত যায়নি, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। আর তাদের ওই ঘৃণ্য অপচেষ্টা যে শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে- এটি আজ প্রমাণিত।
শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে একটি আদর্শ ও ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকার বঞ্চিত শিশু-কিশোরদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রাম থেকে শহর তথা বাংলাদেশের প্রতিটি লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ুক এবং সরকার শেখ রাসেলের ১১ বছরের জীবনগল্পের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরবে- এটাই জাতির প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)