বাংলাদেশ বহু মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, আন্দোলন, সাধনা ও দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ মহিমান্বিত ফসল। যুগে যুগে মহান মানুষগণ দেশকে শত্রু মুক্ত করতে, দেশের মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে, স্বাধীনতার সূর্য সন্তানকে ছিনিয়ে আনতে, মুক্ত চিন্তার সুবাতাস নিতে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পিছপা হননি। আমাদের জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামময় জীবন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় সারা বাংলায় অবাধ বিচরণ, আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদান, ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
এ স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ১ কোটি মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদাররা। সংগ্রামের সফলতা অর্জনের পিছনে অনেকেই যেমন সামনে থেকে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন আবার অনেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে পর্দার আড়ালে থেকে মুক্তিসংগ্রামকে বেগবান করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম একজন, যিনি অন্তরালে থেকে কাজ করেছেন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের জন্য, সাধারণের মধ্যে অসাধারণ, বাঙালি বধূ থেকে ইতিহাসের মোক্ষম সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন তিনি আমাদের ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পুরো নাম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, জাতির জনকের সহধর্মিণী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জননী, বঙ্গবন্ধুর আদরের রেণু। শুধু কী বঙ্গবন্ধুর আদরের পাত্র ছিলেন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মীর নিকট কখনো মমতাময়ী মা, বড় বোন এবং পরম নিরাপদের আশ্রয়স্থল। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার পেছনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদান “অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে” অসংখ্যবার উল্লেখ করেছেন শেখ মুজিব।
ফজিলাতুন নেছা মুজিব তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, সম্মোহনী শক্তি, কর্মীসুলভ মানসিকতা, আতিথেয়তা, নির্মোহ যাপিত জীবনের কারণে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ফজিলাতুন নেছা মুজিব শেখ মুজিবের প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পর্দার অন্তরালে থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহস যুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন যথার্থ সহধর্মিণী হিসেবে, রাজনৈতিক বোদ্ধা হিসেবে এবং কখনো কখনো সিদ্ধান্ত দিয়ে সঠিক কাজটি করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল জনপ্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” গ্রন্থটি দেশে বিদেশে (বিদেশি কয়েকটি ভাষায় অনূদিত) ব্যাপক আলোচিত হয়।
বইটি এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপনের একটি উৎকৃষ্ট দলিল হিসেবে ইতিমধ্যে পরিগণিত হয়েছে। নতুন প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের জন্যও বইটি একটি প্রামাণিক দলিল এবং রাজনীতির পাঠ হিসেবে অবশ্যম্ভাবী। এই বইটি অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী লেখনির পেছনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদান গ্রন্থের প্রথমেই তুলে ধরেছেন জাতির জনক। তিনি বলেছেন,“আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। বললাম, লিখতে যে পারি না, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে কি জনসাধারণের কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুক বলতে পারি নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”
শেখ মুজিব আরো উল্লেখ করেছেন, “আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিলো, জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিলো তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।” কাজেই, অনুধাবন করা যায় ‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’ লেখার মূল অনুপ্রেরণা বেগম মুজিবের কাছ থেকেই পাওয়া।
এই বিশেষ গ্রন্থটি প্রকাশ না হলে আমরা পাকিস্তান গঠন এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ গঠনের অনেক ঘটনা থেকেই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেতাম। এ গ্রন্থটির মাধ্যমে আমরা যেমন নাম না জানা অনেক দেশপ্রেমিকের নাম জানতে পেরেছি, ঠিক তেমনিভাবে দেশবিরোধীদের কার্যকলাপ সম্বন্ধেও অবগত হয়েছি। সুতরাং, ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বিশেষ অবদান এবং তাগিদের কারণে শেখ মুজিবের আত্মজীবনী এখন আমাদের দোরগোড়ায়। বইটিতে ফজিলাতুন নেছার সামগ্রিক অবদান নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে প্রথিতযশা যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে রাজনীতির স্রোতধারায় আমৃত্যু কাজ করেছিলেন তাদের প্রত্যেকের জীবনে তাদের স্ত্রীদের অবদান সকলেই বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। জীবনের প্রতিটি ধাপে, ভাঙন-সৃষ্টির অমোঘ নিয়তিতে স্ত্রীর পরামর্শ ও সম্মোহনী শক্তি রাজনীতির বীর পুরুষদের দিয়েছে সাহস, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা। আফ্রিকান রাজনীতির দিকপাল, গণমানুষের প্রিয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক উত্তরণে সহধর্মিণী উইনি ম্যান্ডেলার অবদান বিভিন্ন জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, মাহাত্মা গান্ধীও তার স্ত্রী কস্তুর বাঈ গান্ধীর অবদানের কথা তুলে ধরেছেন এবং উক্ত দুজনেই বিশ্ব রাজনীতিতে অমর হয়ে আছেন তাদের কৃতকর্মের মাধ্যমে।
ঠিক তেমনি আমাদের বাংলাদেশেও গণমানুষের নেতা, স্বাধীনতার প্রবক্তা, রাজনীতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান এবং বিশ্ব রাজনীতিতে অমরত্ব লাভের অন্যতম অংশীদার ফজিলাতুন নেছা মুজিব। রাজনৈতিক জীবনের অনেকটা সময় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন (১৩ বছর ৬ মাস), এ সময়টাতে দলীয় নেতাকর্মী, পারিবারিক জীবন, আত্মীয়স্বজন ও সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ফজিলাতুন নেছা মুজিব উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের পাশে নিজস্ব যোগ্যতায় আপন আলোয় উদ্ভাসিত ছিলেন ফজিলাতুন নেছা। স্বামীর বিশাল জনপ্রিয়তার মাঝেও আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ছিলেন ফজিলাতুন নেছা।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ফজিলাতুন নেছা মুজিবের শৈশবকাল মোটেই সুখকর ছিলো না। মাত্র ৩ বছর বয়সেই তার বাবা মারা যান, মা মারা যায় ৫ বছর বয়সে। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। রেণুর বাবার নাম শেখ জহুরল হক ও মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। অর্থাৎ, অল্প বয়সেই জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছিলেন রেণু। শেখ মুজিব উল্লেখ করেন “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা (শেখ কাসেম) আমার আব্বাকে ডেকে বললেন তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুইবোনকে লিখে দিয়ে যাব। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহের রেজিষ্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান, একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান।”
সুতরাং বাচ্চাকালে আপনজন হারানোর ব্যথা বেদনা নিয়ে ফজিলাতুন নেছা’কে জীবনধারণ করতে হয়েছে শেখ মুজিবের মাতা সাহেরা খাতুনের তত্ত্বাবধানে। মূলত শেখ মুজিবের পরিবারেই লালিত পালিত হয়েছেন ফজিলাতুন নেছা। শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যান্য ভাই-বোনের ন্যায় রেণুও বেড়ে উঠেছিলেন এবং বাবা-মা হিসেবে শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনকেই জানতেন।
রেণুর বাবা যশোরে একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি করতেন। দু বোনের মধ্যে রেণু ছিলেন ছোট, বড় বোন জিন্নাতুন্নেসা। রেণু দেখতে অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন, সৃষ্টিকর্তা আপন মহিমায় সৃষ্টি করেছিলেন রেণুকে। শেখ রেহানার ভাষ্যমতে, ‘ফজিলাতুন নেছা ছিলেন কটা চোখের দুধে-আলতায় গড়া একটা পুতুল। বাবা-মা’র কাছে মনে হতো ফুলের রেণুর মতো। তাই ডাকতেন রেণু বলে।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘প্রথম দিকে মা খুব কান্নাকাটি করতেন। বিশেষ করে তার বাবার জন্য। দাদি তখন মা’কে বললেন, ‘আমি তোমার বাবা।’ সেই মতো তিনি দাদিকে বাবা আর দাদাকে ডাকতেন আব্বা।’ এমনভাবেই তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে নিবিষ্ট ছিলেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সবাই মানে ভাইবোনেরা বঙ্গবন্ধুকে মিয়া ভাই ডাকতেন, রেণুও সবার দেখাদেখি মিয়া ভাই ডাকতেন। পরে সায়েরা বেগম বঙ্গবন্ধুকে ‘দুলা’ মিয়া ডাকতে অভ্যস্ত করে তোলেন রেণুকে। এভাবেই পারিবারিক বন্ধনের নিবিড় সন্নিবেশে বেড়ে ওঠে ফজিলাতুন নেছার জীবন। পারিবারিক শিক্ষার কারণে ফজিলাতুন নেছা নিজেকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন এবং পরবর্তীতে নিজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এ গুণটির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। নিজস্ব চেতনায় এবং তাগিদে তিনি পড়াশোনা করতেন। ঐ সময়টায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষেধ ছিল। ফজিলাতুন নেছা মুজিব মিশনারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। বাড়িতে আরবি শেখানোর জন্য মাস্টার রাখা হয়েছিল। বাংলা, ইংরেজি, অংক শিক্ষার জন্যও গৃহশিক্ষক ছিল। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি ভাললাগা ছিল রেণুর। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। পাশাপাশি ফজিলাতুন নেছা মুজিবের উচ্চশিক্ষার প্রতিও প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু
পারিপার্শ্বিকতার কারণে সে সময়ে তা সম্ভব হয়ে ওঠে নাই। তবে সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। শত বিপদ-আপদের মাঝেও তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবদ্দশায় ১৩ বছর ৬ মাস জেলে ছিলেন। এ সময়টাতে তিনি সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজে সবকিছুর খোঁজ-খবর রাখতেন প্রতিনিয়ত। পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহ আর ভালোলাগা ব্যক্তি ফজিলাতুন নেছাকে বিবেকবান ও দায়িত্বশীল করে তুলেছিল।
বাল্যকাল থেকেই ফজিলাতুন নেছা ছিলেন সহজ, সরল, নম্র ও ভদ্র স্বভাবের। প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গে দারুণভাবে মুগ্ধ হতেন ফজিলাতুন নেছা। মূলত প্রকৃতির কাছ থেকেই তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন। প্রকৃতি প্রেম তার চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির কাছ থেকেই তিনি নিজেকে পরিশীলিত, নির্মল ও মার্জিত হওয়ার মানসিকতা বপন করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না পেলেও শেখ বাড়িটিই একটি চমৎকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। পারিবারিক পরিমণ্ডলে নিজেকে সৎ এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করার বাসনা ও লালসা কিন্তু শেখ পরিবারের কাছ থেকেই পাওয়া। ছোটবেলা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল ফজিলাতুন নেছার। কিন্তু সমকালীন বাস্তবতা ও মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে ফজিলাতুন নেছার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। তবে, বাল্যকালে ফজিলাতুন নেছার পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল পবিত্র কুরআন শরিফ, বাল্যশিক্ষা, বর্ণ পরিচিতি, বাংলা, ইংরেজি, অংক, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি। বাল্যকালের পঠিত শিক্ষা তিনি পরবর্তীতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছিলেন। প্রকৃতি প্রদত্ত শিক্ষা এবং পঠিত শিক্ষার পাশাপাশি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন ফজিলাতুন নেছা। গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুই তার স্মৃতির বাইরে থাকতো না। পারিবারিক বিষয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল রেণুর নখদর্পণে। একবারের ঘটনা ছিল এমন স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরে ধানমন্ডির লেক দিয়ে কামালকে নিয়ে মণিদের বাসায় যাচ্ছিলেন বেগম মুজিব। হঠাৎ করে লেকের একপাশে কামালকে থামতে বললেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। এ প্রসঙ্গে শেখ রেহানা বলেন, মা কামাল ভাইকে বলেন ‘দ্যাখ, দ্যাখ কামাল, ওই লোকটা আমার বিয়ের তোয়ালেটা গায়ে দিয়ে যাচ্ছে।’ কামাল থেমে বললো, ‘মা তোমার তিন বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে, আর সেই বিয়ের তোয়ালে ওই লোকটা গায়ে দিয়ে যাচ্ছে। কি যে বলো তুমি।’ রেণু বললো, ‘যা লোকটাকে একবার জিজ্ঞেস করে আয় ও তোয়ালেটা কোথা থেকে কিনেছে। দেখবি এক কোণে লেখা আছে মেইড ইন জার্মানি।’
সাথে সাথে শেখ কামাল লোকটার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে টাকা দিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে আসেন। লোকটা স্বীকার করে তোয়ালেটা সামান্য টাকা দিয়ে ৩২ নম্বর এর সামনে থেকেই কিনেছে। পরে বাসায় নিয়ে আসার পর দেখা যায়, তোয়ালের এক কোণে মেইড ইন জার্মানি লেখা রয়েছে। হারানো স্মৃতি ফিরে পেয়ে রেণু সেদিন মহা খুশি হয়েছিলেন। এই তোয়ালে দিয়েই ফজিলাতুন নেছার শ্বাশুড়ি সায়েরা খাতুন আদরের রেণুকে গোসল করিয়ে মাথা মুছে দিতেন। এই তোয়ালের কথা কী সহজেই ভোলা যায়, তিন বছরের স্মৃতি তিনি তুলে ধরেছেন কতদিন পরে। একমাত্র প্রজ্ঞাবান ও তুখোড় পর্যবেক্ষণ শক্তি সম্পন্ন মানুষের পক্ষেই এমনটি সম্ভব।
চলবে…