বাংলা গানের রাজপুত্র বলা হয় শচীন দেব বর্মণকে । ওমন দরাজ গলা আর সুরের ঐন্দ্রজালিক শক্তি দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এই উপমহাদেশের ‘গানের কর্তা’।
শচীন কর্তার গলা যেন তার গানের ডাকাতিয়া বাঁশির মতোই। সবাইকে হরণ করে নিয়ে যায় সুরের পৃথিবীতে। প্রবল আকুতি ভরা কণ্ঠে তিনি গেয়েছেন ‘তুমি এসেছিল পরশু, কাল কেন আসনি…শোন গো দখিনা হাওয়া, তুমি আর নেই সে তুমি।
বাংলা গানের কিংবদন্তি গায়ক, অবিস্মরণীয় সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেবের ৪২ তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর বিদায় নেন জীবনের জলসাঘর থেকে।
সুরের এ অনন্য স্রষ্টার পরিচয়টা কিন্তু অন্য রকমও হতে পারতো। হয়তো গায়ক হিসেবে না চিনে আমরা তাকে ফুটবল মাঠেও দেখতে পারতাম। অসম্ভব রকম খেলাধুলা ভালোবাসতেন শচীন কর্তা। নিজেও ভালো টেনিস খেলতেন। কিন্তু গান আর ফুটবল-দুটো কি সমান্তরালে যায়?
আর তাই গানকেই বেছে নিয়েছিলেন অবশেষে। আর নিজের খেলোয়াড় সত্ত্বাকে দিয়েছিলেন বিসর্জন। নয়তো কে জানতো, হয়তো তাকে ভারতীয় ফুটবল দলের জার্সি গায়েও দেখা যেত! তবে নিজে খেলাধুলা ছাড়লেও প্রচুর খেলা দেখতেন তিনি।
সুরের নেশায় সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যাওয়া শচীন দেব বর্মণ বাংলা গানকে দিয়েছিলেন নতুন মাত্রা। কবি নজরুল ইসলাম, কবি জসীম উদ্দিনের কবিতাকে সুরের জীবন দিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মণ। বাঙালি এখনো মজে আছে শচীন কর্তার সুরের মাধুরীতে। শুধু বাংলাদেশ নয়, তিনি ও তাঁর গানের জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছিলেন বিশ্বজোড়া।
১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেব বর্মণ। শচীন দেব শৈশব থেকেই লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেন এবং রাগসঙ্গীতের সংমিশ্রণে সুরারোপ করে নতুন সুরজাল সৃষ্টি করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করে তিনি ত্রিপুরার রাজদরবারে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে চাকরি ছেড়ে কলকাতা গিয়ে ওস্তাদ বাদল খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ভীষ্ম দেব, কানা কৃষ্ণ প্রমুখ সঙ্গীত বিশারদের নিকট রাগসঙ্গীতে আনুষ্ঠানিক তালিম নেন।
১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে শচীন দেব প্রথম গান করেন এবং ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়। তিনি নজরুল সঙ্গীতও রেকর্ড করেন। এরপর তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়।
শচীন দেব অনেক বাংলা গানে সুর দিয়েছেন। ১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মিলনে গান গেয়ে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি।
তিনি ১৯৪৪ সাল থেকে মুম্বাই-এ বসবাস করেন এবং আশিটির মতো হিন্দি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করে চিত্রজগতে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। সেখানে তিনি ‘শিকারি, দেবদাস, সুজাতা, বন্দিনী, গাইড, আরাধনা, বাজি, শবনম, দো ভাই’ মত ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
শুধু গায়ক আর সুরকার হিসেবেই খ্যাতি পাননি শচীন দেব বর্মণ, তিনি তৎকালীন কলকাতা ইস্ট বেঙ্গল দলের একজন ফুটবল খেলোয়াড়ও ছিলেন এবং খুবই সুন্দর তবলা ও বাঁশি বাজাতেন, একজন বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদীও ছিলেন তিনি। তিনি ১৯৬৯ সালে ভারতের সম্মানজনক’পদ্মশ্রী’ উপাধি পান এবং সেই বছরই হিন্দি গানের নেপথ্য গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়।
শচীন দেব বর্মণ তাঁর সঙ্গীত জীবনের পুরো সময়ের বর্ণনা লিখে গেছেন ‘সরগমের নিখাদ’ বইটিতে। সংগীতে তাঁর অসমান্য অবদান উপমহাদেশ শ্রোতাদের চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।