চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

শিশু নির্যাতন: কেনো এই বর্বরতা?

মানুষের মধ্যে যে সমস্ত মানবিক গুণাবলীর অভাব একটা সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনে সেগুলোর মধ্যে শিশু নির্যাতন অন্যতম। শিশুরা সুন্দরের প্রতীক, পবিত্রতার প্রতীক, নিস্বর্গ আনন্দের উৎস। প্রতিটি শিশুর নিরাপত্তা ও সঠিকভাবে গড়ে উঠার জন্য দরকার তার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর আদর-ভালোবাসা-যথাযথ পরিচর্যা ও সঠিক দিক নির্দেশনা। এক কথায় একটা সুস্থ পরিবেশ ও নিরাপদ আশ্রয়।

পরিতাপের বিষয় হলো দেশে শিশু নির্যাতন সমান্তরালে বাড়ছে। দিন দিন নিত্য নতুন কৌশলেও এটি রূপ লাভ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার পাশাপাশি অপরাধীরা অনুকরণ করছে হলিউড বলিউডের ফিল্মি স্টাইল।

শিশু নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন,“শিশু নির্যাতন করে কেউ পার পাবে না।” ১৮ অক্টোবর (রোববার) সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশে পরপর বেশ কয়েকটি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।” এ ধরনের খারাপ প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সম্প্রতিক সময়ে শিশু রাজন নির্যাতন একটি আলোচিত ঘটনা। ১৩ বছরের শিশু সামিউল ইসলাম রাজনের শরীরে ৬৪টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিলো। চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘ ২৮ মিনিট ধরে চলে তার ওপর নির্যাতন। এ নির্যাতনের পুরো প্রক্রিয়াটি ভিডিও করে বিকৃত মানসিকতার নির্যাতনকারীরাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর পল্লবীতে ডাস্টবিনের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় নির্যাতনের বীভৎস শিকার গৃহকর্মী আদুরিকে। খুলনায় ১৩ বছরের সীমাকে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী শুধু হত্যাই করেনি, দীর্ঘ ৯ মাস ডিপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল।

সাম্প্রতিক সময়ের শিশু নির্যাতনের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫৮০৫টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। শিশু অধিকার ফোরাম,অধিকার ও পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে,চলতি বছরের ৯ আগস্ট পর্যন্ত ১৯৩ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যমতে, ২০১২ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ২০৯ জন শিশু। এছাড়া আরও ৫ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০১৩ সালে হত্যা করা হয় ২১৮ শিশুকে এবং ১৮ শিশুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০১৪ সালে ৩৫০ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়;হত্যার চেষ্টা করা হয় ১৩ শিশুকে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ১৯১ শিশুকে এবং ১১ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।বিএসএএফ সূত্র জানায়, গত সাত মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩০ শিশু; ৬২ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে; ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ শিশুকে। এ সময়ে অপহৃত হয়েছে ১২৭ জন শিশু; অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৩ জন শিশুকে।

বিএসএএফ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে অপহৃত হয় ১১৮ জন শিশু। এদের মধ্যে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়। ৬৬ জন অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালে ৪২ জন শিশু অপহরণের শিকার হয়। তাদের মধ্যে হত্যা করা হয় ১৩ জনকে। ২০১২ সালে ৬৭ জন শিশু অপহৃত হয়।

শিশু ও মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১ মে থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে সারাদেশে ১০২৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত ৩ মাসে হত্যা করা হয়েছে ১৬০ জনকে, যাদের অধিকাংশই শিশু।

চলতি বছরের গত ৬ মাসে ৯০টি শিশু অপহৃত হয়েছে।মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ৬টি জাতীয় পত্রিকার খবর পর্যালোচনা করে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০১৩’ প্রতিবেদনে বলছে, বছরটিতে ২৬৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে মারা যায় ১২ জন। গুরুতর আহত হয় ২৩৯ জন শিশু।

ধর্ষণ ছাড়া অন্যান্য যৌন নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয় ১৫০টি। তবে ২০১২ সালে ১৫৫ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী,বছরটিতে ৯০ শিশু অপহরণের শিকার হয়। অপহরণের পর খুন করা হয় দুজনকে।

পারিবারিক কলহ, মুক্তিপণ না পেয়ে, জমিজমা নিয়ে বিরোধ ও মা-বাবার পরকীয়ার জেরে ৩৩৫ শিশু খুন হয়। অশ্লীল ভিডিওচিত্র ছড়ানোর ভয়ে বা অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করে ১৬৬ শিশু। বিভিন্ন অপরাধী কর্মকাণ্ডে ২৪৫ শিশুকে সম্পৃক্ত করা হয়। এর মধ্যে মারা যায় ১৭৬ জন। বছরটিতে পাচার হয় ৪২ শিশু। অ্যাসিডদগ্ধ হয় ১০ শিশু।

রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে ৪১ শিশু মারা যায়। ১০৭ শিশু গুরুতর আহত হয়।বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সাড়ে ৩ বছরে দেশে ৯৬৮টি শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শিশুহত্যার হার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬১ শতাংশ বেশি ছিল।

এ বছর হত্যার পাশাপাশি বেড়েছে নৃশংসতা। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২৬৭টি সংগঠনের মোর্চা শিশু অধিকার ফোরামের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে ২০৯, ২০১৩ সালে ২১৮, ২০১৪ সালে ৩৫০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের সাত মাসেই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১৯১ জনে। আর কতো শিশু যে প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান করা আদৌ সম্ভব নয়।

শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ অপহরণের ঘটনা। এগুলোর মধ্যে কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও বেশিরভাগই ধামাচাপা পড়ে যায় লোকলজ্জার কারণে। বছরে কত শিশু নির্যাতিত হচ্ছে,সে বিষয়ে সরকারি কোনো তথ্য নেই। বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারের নানা সংস্থার কাছ থেকে কিছু খন্ডিত চিত্র পাওয়া যায় মাত্র।

বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে নির্যাতন ও পিটিয়ে শিশু হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফও। ৬ আগস্ট এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেদার জানান, এ ঘটনা ‘শিশু অধিকার’ নীতির পরিপন্থী। ঘটনাগুলো সারা দেশকে নাড়া দিয়েছে, তাই ইউনিসেফ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাইকেল ম্যাকগ্রাথও শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার শিশুদের জন্য যে নীতিগুলো গ্রহণ করেছে তার আলোকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সংবিধানে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি শুধু কথায় নয়, কাজে পরিণত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।আমাদের দেশের আইন অনুসারে ১২ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি মানুষ শিশু। প্রশ্ন হচ্ছে এই বয়সের একটা মানুষ কেন নির্যাতনের শিকার হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেই বেরিয়ে আসবে শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন পর্যায়গুলো। অর্থাৎ কোন কোন শিশুরা নির্যতিত হচ্ছে এবং কাদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে?বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের চিত্র যে কতোটা ভয়াবহ এবং কতোভাবে যে শিশুরা নির্যাতিত হয়ে থাকে সেটা ভাবলেও শরীর শিউরি উঠে!

আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ প্রচলিত আছে। এই আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি বিষাক্ত, দাহ্য বা দেহের ক্ষয় সাধনকারী কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটায় তবে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। অন্যথায়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ন্যূনতম ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।

এতোসব আইনের ভেরি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে অহরহ নানাভাবে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে,যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এসব শিশু নির্যাতনের যে ভয়াবহতা তা যে কোন সভ্য-শিক্ষিত সমাজের জন্য কলংকস্বরূপ। শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা যতদূরই অগ্রসর হই না কেন,আমাদের সব অগ্রযাত্রা ম্লান হয়ে যায় এসব নির্যাতনের দৃশ্যপটের সামনে।

আমরা চাই দেশে প্রচলিত শিশু নির্যাতনবিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হোক,বন্ধ হোক বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠুক নিরাপদে-সুস্থদেহে-সুস্থমনে-উজ্জল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)