সাম্প্রদায়িকতা যেন এক বিষের নাম। আর এই বিষ ধ্বংস করে দেয় অনেক অনেক সম্পর্ককে। ছোট থেকেই একটি শিশুর মননে গড়ে তোলে এক ধরনের বিভেদ। যেটা দিয়ে সে তার চারপাশে থাকা মানুষগুলোর মধ্যেও তৈরি করে বিভেদ।
একসময় সেই সাম্প্রদায়িকতাই রূপ নেয় জঙ্গিবাদে। তাই এসব সমস্যার সমাধানে পরিবারের বিশেষ সচেতনতার কথাই বললেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি এজন্য দরকার সবার আগে পরিবারের সচেতনতার। তারপর আরো বেশি সচেতন হতে হবে শিক্ষকদের।
সাংস্কৃতিক বিদ্যালয় বাতিঘরের পরিচালক তামান্না সেতু মনে করেন, একটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় স্থান তার পরিবার। সেখানে সে যা দেখবে তাই শিখবে। তাকে যদি হিংসা-হানাহানি-বিদ্বেষ শেখানো হয় সে যেমন সেটাই গ্রহণ করবে তেমন তাকে সম্প্রীতি শেখানো হলে সে সেটাই শিখবে। সব ধর্মের প্রতিবেশীর সঙ্গে যদি পরিবারের ভালো সম্পর্ক থাকে তাহলে সেটা শিখবে শিশুও। আর পরিবারের বাইরে ভাবতে গেলে শিশুকে গড়ে তোলার দ্বিতীয় স্থান হলো তার বিদ্যালয়। অনেক স্কুলে শিক্ষকরাই সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলেন। সেসবও তো শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিশুর আচরণ অন্যের দ্বারা অনেকখানিই নিয়ন্ত্রিত হয়। সেকথা উল্লেখ করে তামান্না সেতু বলেন, অন্যের আচরণ শিশুর মনে অনেক অনেক প্রভাব ফেলে। সেজন্য তারও কিছু চর্চার মধ্যে রাখতে হবে। তাকে তার নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতি পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর নজর দিতে হবে তার বই পড়ার দিকে। আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলাটাও অব্যাহত রাখতে হবে। ওই সময়ে কিন্তু কেউ হিন্দু মুসলমান ভেবে যুদ্ধে যায়নি। সেটা কোনো হিন্দু বা মুসলমানের যুদ্ধও নয়। দেশীয় সংস্কৃতির শেকড়ের গল্পটা শুনলে শিশুর মনেও সবার জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি হবে বলেই মনে করেন তামান্না সেতু।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের শংকরবাটী পোল্লাডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা খাতুন পরিস্থিতি বোঝাতে স্কুলের বাচ্চাদের কিছু গল্প শোনান। সেখানে এক শিক্ষার্থী যেমন অন্য ধর্মের একটি শিক্ষার্থীর ধর্মগ্রন্হ পা দিয়ে ঘষে দেওয়ার ঘটনা আছে। তেমন এক ছোট্ট শিশুর ‘ও হিন্দু, ওকে ছুঁলে আমিও হিন্দু হয়ে যাবো।’ এমন বলার ঘটনাও আছে। মনোয়ারা খাতুনের বক্তব্য- এই বয়সেই এসব শিশুর কিন্তু এসব বোঝার কথা নয়। ওকে এসব বোঝানো হয়েছে। আর সেটা হয়েছে পরিবারে। পরিবারকেই আগে সচেতন হতে হবে সন্তানদের মন থেকে এসব সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করতে।
এরপরেই দ্বায়িত্বটা বর্তায় শিক্ষকদের উপর। তিনি যোগ করেন, তবে অনেক সময় পরিবারের কারণে শিক্ষকদেরও কিছু করার থাকে না। শিশু আগে তার মায়ের কথা শুনবে তারপর শুনবে শিক্ষকের কথা। শিক্ষকদের যেসব ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয় সেখানে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা হয়। কিন্তু যারা ট্রেনিং করায় বা করে তারা নিজেরাই কি সবাই সেটা মানেন? শিশুর মনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মনোভাব তৈরি করতে হলে নিজ ধর্মচর্চার পাশাপাশি অন্য ধর্মের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচয় করাতে হবে।
তাছাড়া বই পড়ার উপরও গুরুত্ব দেন এই শিক্ষক। বলেন, শিশুর মানসিক অবস্থা তৈরি করতে হলে বই পড়ার তো বিকল্প নেই। এমনকি সে নিজের ধর্মগ্রন্থটাও ঠিক করে পড়লে বুঝবে, সেখানেও সম্প্রীতির কথাই বলা হয়েছে। স্কুলে লাইব্রেরি করা বা কোনো আয়োজনে বই উপহার দেওয়া হতে পারে ভালো সমাধান। তবে সবার আগে শিক্ষকদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে তাহলে শিশুদের পরিবর্তনটা সহজ হবে।
মাদারীপুরের ২৭ নং হোগলা মাকসাহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আফরোজা আক্তারও মনে করেন, বাবা-মা সচেতন হলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তারপরেই প্রধান ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকরা। বই পড়া বা সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ দিলেও শিশুদের মানসিকতার বিকাশ ঘটবে অনেকটাই। তবে শিশুদের আরো বেশি সুস্থ মানসিকার করে গড়ে তুলতে শিক্ষদের আরো বেশি সচেতন থাকতে হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
ছোটবেলাতেই শিশুর মানসিক ভিত্তি গড়ে উঠে। ওই সময়টাতে তাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুললে সেই বোধশক্তি বড় হয়েও তাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করবে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।