চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

শিশুর পায়ে ব্যাথা হলেই বাতজ্বর নয়

রোহান; বয়স ৯ বছর। এই ছেলেটির প্রায়ই পা ব্যথা করে,  বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশীগুলোতে বেশি ব্যথা করে যেদিন বেশি হাঁটাহাটি হয় কিংবা স্কুলে খেলাধুলা করে সেদিন সমস্যাটি বেড়ে যায়।

এটি প্রথম দেখা দেয় ৩ বছর আগে। তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি কিছু পরীক্ষা করান, এর মধ্যে এএস ও টাইটার বেশি পেলে বাতজ্বর হয়েছে বলে প্রতিমাসে মাংসে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন নেয়ার পরামর্শ দেন। সেই থেকে প্রতিমাসে ইঞ্জেকশন নিচ্ছে, তারপর ও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই তার মায়ের মনে প্রশ্ন এত ইঞ্জেকশন নিচ্ছে তারপরও কেন এই পায়ে ব্যথা?

রোহানের মত অনেক ছেলেমেয়েরা এরকম পায়ে হাতে ব্যথার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তারা কিছু পরীক্ষা করান। আর এই টাইটার বেশি পেলে বাতজ্বর আখ্যা দিয়ে বছরের পর বছর পেনিসিলিন ট্যাবলেট কিংবা ইঞ্জেকশন দিতে থাকেন। পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে অনেকের বাতজ্বর ভুল প্রমাণিত হয়। তবে এই চিকিৎসায় শিশুটির শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি অনেক অর্থ এবং সময় অযথা নষ্ট হয়ে যায়। 

তাহলে আসুন জেনে নিই বাতজ্বর কী?

‘বাতজ্বর’কে ইংরেজিতে বলে রিউমেটিক ফিভার। এটা বাচ্চাদের একটি প্রদাহজনিত রোগ। গলায় স্ট্রেপটোকক্কাস নামের অণুজীবের সংক্রমণের পর তার বিরুদ্ধে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা আবার হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, পিঠ, চামড়া ইত্যাদি স্থানের টিস্যুকে আক্রমণ করে প্রদাহজনিত রোগের সৃষ্টি করে। 

বাতজ্বরের ঝুঁকিপূর্ণ কারা?

এটা সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের বাচ্চাদের বেশি হয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রী দলবদ্ধ হয়ে থাকা, কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় বসবাস করলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে স্ট্রেপটোকক্কাস দিয়ে গলা ব্যথা জাতীয় রোগ হওয়ার ৭/৯ দিনের মধ্যে এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করলে বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

বাতজ্বর হলে বুঝবেন কী করে?

আগেই বললাম এই বাতজ্বর মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, পিঠ, চামড়া ইত্যাদি অনেক স্থানকে আক্রমণ করে। তাই কোনো একক লক্ষণ কিংবা পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তাররা এটা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করতে পারেন না। তাই অনেক গবেষণার পর একজন বিজ্ঞানী এটা নির্ণয়ের যে বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দিয়েছেন তার অনুসারে সেটা জোনস নির্ণায়ক এবং কিছু পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে পরিবর্তিত জোনস মানদণ্ড নামে চিকিৎসকদের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় হয়ে আছে। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তিনি ৫টি মুখ্য এবং কিছু গৌণ বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। সেই সঙ্গে থাকতে হবে স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ।

মুখ্য বৈশিষ্ট্যের যে কোনো দু’টি অথবা একটি মুখ্যর সাথে দু’টি গৌণ বৈশিষ্ট্য এবং সম্প্রতি স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে বাতজ্বর হিসেবে ধরতে হবে অন্যথায় নয়। 

এই মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো –

১. হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ

২. হাত ও পায়ের বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহ

৩. মস্তিষ্কে প্রদাহজনিত কাঁপুনি খিঁচুনি

৪. চামড়ার লাল দাগ

৫. চামড়ার নিচে আর গৌণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থাকতে পারে হাতে-পায়ে হালকা ব্যথা, জ্বর বেড়ে যাওয়া এবং দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া। তবে এদের সাথে অবশ্যই সম্প্রতি সংক্রমণের প্রমাণ হিসেবে গলা পরীক্ষায় জীবাণুর অস্তিত্ব, বাড়তি টাইটার থাকতে হবে।

গৌণ বৈশিষ্ট্যের কিছু ধারণা – 

১. হৃৎপিণ্ডে প্রদাহ; শতকরা ৪০/৮০ ভাগ বাচ্চার এটা হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যাওয়া এবং হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া, অনিয়মিত স্পন্দন, বাড়তি হৃৎকম্পন দেখেও ডাক্তাররা এটা নির্ণয় করতে পারেন।

২. শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর পায়ের হাতের বড় বড় জয়েন্টে এই প্রদাহ থাকতে পারে। যার ফলে জয়েন্টগুলো ব্যথা করে ও ফুলে যায়। সাধারণত মাংসপেশীতে ব্যথা করে না।

তাই মনে রাখতে হবে পায়ে ব্যথা কিংবা পায়ের মাংস ব্যথা হলেই বাতজ্বর এমনটি ঠিক নয়। ওপরে উল্লেখিত রোহানের এই পায়ে ব্যথার কারণ হলো ‘গ্রোয়িং পেইন’ নামক সাধারণ একটি সমস্যা। ব্যথার নামটি ‘গ্রোয়িং পেইন’ হলেও শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কেন শিশুরা এই ব্যথায় আক্রান্ত হয়, তার সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে শিশুর সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি ও খেলাধুলাকে এজন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

সাধারণত তিন বা চার বছর বয়স থেকে শিশুর গ্রোয়িং পেইন শুরু হয় এবং আট থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত সে এই ব্যথা অনুভব করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ব্যথার মাত্রা কমে যায় বা ব্যথা আর হয় না। শিশুর গ্রোয়িং পেইন তার দীর্ঘমেয়াদী কোনো ক্ষতি করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রোয়িং পেইনের ব্যথা শিশুর উরুর সামনের বা পায়ের পেছনের মাংসপেশীতে হয়। কখনও কখনও হাতেও ব্যথা হতে পারে।

তবে কখনোই এই ব্যথা হাত-পায়ের কোনো গিরাকে আক্রমণ করে না। শিশুর গ্রোয়িং পেইনের ব্যথা কমানোর জন্য তার পায়ের মাংসপেশীর কিছু ব্যায়াম করতে হবে। পাশপাশি হালকা গরম করে সেক দেয়া যেতে পারে।

তাই শিশুর পায়ে ব্যথা হলে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিতে হবে।