সোমবার সকালে একটি কাজে মগবাজার থেকে হেঁটে বেইলি রোড যাচ্ছিলাম। রমনা থানা থেকে একটু সামনে এগোলেই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ছোট-বড় অসংখ্য শিক্ষার্থী আর তাদের মায়েদের ভিড় ঠেলে ওই জায়গাটুকু যেতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। তবে হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে পড়লো অনেক কিছুই। যা নিয়ে পরে একসময় লিখব বলে মনস্থির করে রেখেছিলাম। কিন্তু অরিত্রির আত্মহননের ঘটনার পর একটু আগেই লিখতে মন চাইছে। যদিও আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করবো না। কে দোষী বা নির্দোষ তার প্রমাণ হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে।
ভিকারুননিসার সামনে দিয়ে যখন হাঁটছিলাম, দেখলাম শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সবাই খুবই ব্যস্ত। শিক্ষার্থীদের সামনে বই বা নোটখাতা, এক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে সেগুলোর দিকে। বুঝতে বাকি রইলো না, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো পরীক্ষা শুরু হবে। পরীক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের মায়েদের আরো ব্যস্ত দেখা গেলো। কেউ পড়া ধরছে, খুবই তাড়াহুড়ো করে। কোন মা দ্রুততার সাথে টিফিন বক্সে আনা খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন হাইস্কুলে পড়া মেয়েদের। খেতে গিয়ে মুখ থেকে খাবার পড়ে যাচ্ছে, কারণ ওই মেয়ের চোখ খাবারে নয়, বই বা নোটখাতায়। শত শত শিক্ষার্থীর কারো মুখে কোন হাসি দেখলাম না। বইয়ে আবদ্ধ চোখ আর ভারী এক পরিবেশ। সিরিয়াস কঠিন চোখমুখ। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার দৌঁড়ের এ এক করুণ দৃশ্য। তাদের দেখে আমার খুব মায়া লাগলো।
পরীক্ষার আগে পড়তে হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেভাবে পড়া মুখস্থ করছিলো, তা দেখলে অবাকই হতে হয়। তবে এতে তাদের কোন দোষ দেয়া যাবে না। হয়তো এতো বেশি পড়ানো হয়েছে, সিলেবাস শেষ করতে চাইলে পরীক্ষার এক মিনিট আগেও এভাবেই সবাইকে পড়তে হবে। না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হবে!
কয়েক মাস আগে চ্যানেল আই সংবাদে আমি একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছিলাম শিশু সংগঠন নিয়ে। এতে তুলে ধরেছিলাম রাজধানীর বড়-মাঝারি বা ছোট-কোন স্কুলেই শিশু সংগঠনের কোন কার্যক্রম নেই। পড়াশোনা ছাড়া শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্যও তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। ভিকারুননিসার মেয়েদের সাথেও কথা বলেছিলাম। তাদের কয়েকজন বলেছিল, পড়াশোনা ছাড়া এই স্কুলে সাংস্কৃতিক কোনকিছু আলাদাভাবে শেখানো হয় না। গুরুত্ব দেয়া হয় শুধু পড়া আর পরীক্ষাকে। রাজধানীর সব স্কুলের অবস্থা অনেকটা একইরকম।
আমার ছেলে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে’তে পড়ে। শুরুতে তার পড়ার সিলেবাস দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। এত্তো পড়াশোনা আমরা ক্লাস ফাইভেও পড়িনি। বলা হয় এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কম পড়িয়ে এখন কোন স্কুল আর বদনাম নিতে চায় না! তাই বেশি বেশি পড়াও। একগাদা হোমওয়ার্ক দাও। বেশি বেশি পরীক্ষা নাও। আর এসব করতে গিয়ে খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোন নামগন্ধই নেই। আমরা ছোটবেলায় যে আনন্দময় শৈশব পেয়েছিলাম, বর্তমান শিশুরা তা চিন্তাও করতে পারে না। চার দেয়ালের বাসায় আর স্কুলের গন্ডির ভেতরে পড়াশোনাময় তাদের জগৎ। যেখানে আনন্দের লেশমাত্রও নেই। শিশুরা যে একটু মুক্তচিন্তা করবে, কল্পনা করবে, সৃষ্টিশীল কিছু নিয়ে ভাববে, তার কোন সময়ই তাদের দেয়া হচ্ছে না। ফলে কী হচ্ছে? ঘরে বাইরে আবদ্ধ পরিবেশে ফার্মের মুরগির মতোই বেড়ে উঠছে রাজধানীর প্রতিটি শিশু। বড় হয়ে তারা কী করবে? গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড় হওয়া আর কম পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীটির চেয়ে কি বেশি এগিয়ে থাকতে পারবে? আমার মনে হয় না।
এখুনি সময় এসব নিয়ে চিন্তা করার। কোমলমতি শিশুদের ওপর থেকে পড়াশোনার চাপ কমান। দিনের পর দিন পরীক্ষার খড়গ থেকে তাদের রেহাই দিন। তাদের বইয়ের বোঝাটা বড্ড ভারী। তাদেরকে মুক্তি দিন। খেলাধুলার সুযোগ তৈরি করুন। সংস্কৃতিমনা হতে দিন। আর সিরিয়াস শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি কেউ নকলও করে বসে তাদেরকে ডেকে নিয়ে বোঝান। অপমান করে কোন ভাল ফল হয় না। তার সর্বশেষ প্রমাণ অরিত্রীর আত্মহনন। আত্মহত্যাকে কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। তবে শিশুদের যেভাবে মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে এটি একেবারে বন্ধ হবে বলে মনে হয় না।
ভাল স্কুল প্রমাণ করতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)