রাজধানীর মিরপুরের বাগবাড়ি এলাকায় একটি কিন্ডারগার্টেনে কেজি ওয়ানে পড়ে রোহান আহমেদ। প্রতিদিন সকালে ৭টায় তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন মা। এরপর নাস্তা করিয়ে স্কুলে নিয়ে যান। ক্লাস শুরু হয় আটটায়। ক্লাস শেষ করে তাকে নিয়ে বাসায় এসে গোসল করিয়ে আবার তৈরি করেন আরেক প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
সন্ধ্যার পর তাকে আবার বসতে হয় স্কুলে দেওয়া হোমওয়ার্ক নিয়ে। কিছুক্ষণ পরে আসে হাউজ টিউটর। তার কাছে প্রায় দেড়ঘণ্টা পড়ে শিশু রোহান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এভাবেই ছুটতে হয় ছয় বছর বয়সী শিশুটিকে। দিনের বেলা খেলাধুলার সুযোগ তো দূরের কথা একটু ঘুমানোর সময়ও পায় না সে।
রোহান আহমেদের মা লিপি আক্তার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: প্রতিদিন অনেকটা জোর করেই ওকে ঘুম থেকে তুলতে হয়। খেতে না চাইলেও অনেকটা জোর করেই খাওয়াতে হয়। ছুটির দিন ছাড়া একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময়ও পায় না রোহান।
রোহানের বাবা সৈকত আহমেদ বলেন: এতটুকু একটা বাচ্চা সেই সকালে উঠে সারাদিন এভাবে পার করে। সন্ধ্যায় হোমওয়ার্ক করার পর আসে টিউটর। তারপরেও ওর মায়ের অভিযোগ আমি নাকি ওকে নিয়ে একটু বসি না। আপনিই বলেন এত চাপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরে আমি আবার নতুন করে কীভাবে ওকে নিয়ে পড়াতে বসি?
শুধু রোহান আহমেদ নয় স্কুল শুরু করা রাজধানীর প্রায় সব শিশুদেরই দৈনন্দিন রুটিন কম বেশি একই রকম। পড়াশুনা এবং বইয়ের বোঝায় নুইয়ে পড়ছে তারা। খেলাধুলার সময় পাচ্ছে না বললেই চলে।উদয়ন স্কুলের সামনে কথা হয় সোনিয়া সুলতানা নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তার মেয়ে সামিয়া ওই স্কুলে কেজি ওয়ানে পড়ছে। সন্তানের দৈনন্দিন রুটিনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন: স্কুল খোলা থাকলেও আসলেও ওর নিজের জন্য কোন সময় থাকে না এটা সত্যি কথা। স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেলে হয়। এরপরে গান শেখাতে নিয়ে যাই, সন্ধ্যায় আসে টিউটর। তারপর রাতের খাবার সারতে সারতে আবার ঘুমের সময় হয়ে যায়।
শাহিদা শারমিন নামের একজন গৃহিনীর তিনটি সন্তান পড়ছে উদয়ন স্কুলে। বড় মেয়ে পড়ছে দশম শ্রেণিতে, ছোট দুই ছেলের একজন চতুর্থ শ্রেণিতে অন্যজন কেজি ওয়ানে। তিন সন্তানকে স্কুলে আনা নেওয়া করা, স্কুলের জন্য তৈরি করা, হোমওয়ার্কের নজরদারি করতে করতেই তার দিন চলে যায়। বাসার কাজে হাত দেওয়ার সময়ই পান না।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: স্কুলে যা পড়ানো হয় তা ঠিকই আছে। বাচ্চাদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো আমার কাছে যথাযথই মনে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত চাপে অনেক সময় বাচ্চাগুলো কাহিল হয়ে যায়।
‘স্কুলের শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান ঠিকই। কিন্তু অনেক সময় বাচ্চারা সেটা ধরতে পারে না। যেমন, মিস একটা পয়েন্ট বললো বা গুরুত্বপূর্ণ টপিকের নাম বললো অনেক বাচ্চাই সেটা ঠিকমত বুঝতে পারে না। এজন্য বিভিন্ন জনের নোট খাতা থেকে পড়ে তা টুকে নিতে হয়। কিন্তু একটু সময় নিয়ে যত্ন করে যদি শিক্ষক ক্লাসে বুঝিয়ে দেন, পড়াটা তৈরি করে দেন তবে বাচ্চাদের জন্য বেশি ভালো হয়।’
এই অভিভাবকের চাওয়া, বাচ্চাদের পড়াগুলো যদি ক্লাসেই তৈরি করে দেওয়া হতো তবে খুবই ভালো হত। হোমওয়ার্কের চাপ থাকতো না। তাতে কিছুটা সময় তারা নিজের জন্য পেত। এই সময়ে খেলাধুলা বা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী অন্যান্য যে কোন কিছু করতে পারতো।
উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল, গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল, তেঁজগাও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুলের একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
সন্তানের দৈনদিন্দন রুটিনে কিছুটা হেরফের থাকলেও তাদের সবারই দাবি: অন্তত প্রাইমারি লেভেলের শিশুদের পড়া যেন ক্লাসেই তৈরি করে দেওয়া হয়।তাতে স্কুলের বাইরের সময়টাতে সে অনেকটা চাপমুক্ত থাকতে পারবে; যা তার মেধার সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। তাছাড়া খেলাধুলা বা অন্যান্য ঐচ্ছিক কাজে যুক্ত হতে পারলে তার শারিরিক বিকাশও সুষমভাবে হবে বলে মনে করছেন তারা।
তবে শিক্ষকেরা বলছেন: তারা শিশুদের পড়া ক্লাসেই তৈরি করে দেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক হলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় হয়ে ওঠে না।
উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক আকতার জাহান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমাদের চেষ্টার কোন কমতি নেই। কিন্তু কিছু সীমাদ্ধতা রয়েছে। আমার ক্লাসের ব্যাপ্তি ৬০ মিনিট, পড়াতে হয় ৬০ জন বাচ্চাকে। তাই চাইলেও অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেটা পারা যায় না।
‘আমাদের দেশের জনসংখ্যা এমনিতেই বেশি। এখন যদি শিক্ষক এবং অবকাঠামো দ্বিগুণ হতো বা শিক্ষার্থী সংখ্যা যদি অর্ধেক হতো তবে হয়তো অভিভাবকদের চাহিদা অনুযায়ী পড়ানো যেত। কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে আমাদেরতো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে’, বলেন এই সিনিয়র শিক্ষক।
এই শিক্ষক মনে করেন: অভিভাবকদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তাদের উচিত এমন পরিবেশ দেওয়া যাতে করে শিশুরা নিজ থেকেই পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদেরকে কোনভাবে জোর করা যাবে না। প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত তাদের ইচ্ছামত পড়তে দেওয়া উচিত। নজরদারি করলেও সেটা দূর থেকে করতে হবে। সরাসরি করলে তাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
কেবলমাত্র ফলাফলের ওপর নজর না দিয়ে শিশুরা আসলে কী শিখছে সে বিষয়ে অভিভাবকদের বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আকতার জাহান বলেন: আপনার সন্তানের ওপর থেকে প্রত্যাশা কমাতে হবে। সে কেমন ফল করলো তার চেয়ে বেশি নজর দিন তারা ঠিকমত শিখছে কি না।