সাংবাদিকতা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর থেকে বড় বড় কথা বলতে হয়। সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়নের শিক্ষক বলে কথা! কিন্তু শ্রেণীকক্ষে লেকচারে আমি যা বলি, নিজের ঘরেই তার বাস্তবায়ন করতে পারছি না।
বলা উচিত পেরে উঠছি না। মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বায়নের নামে আগ্রাসন, কালচারাল হেজিমনি, ডিকলোনাইজেশন অব মাইন্ড, অরিয়েন্টালিজম ইত্যাদি ভারী ভারী বিষয় দিয়ে আমার দারুণ সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীদের মস্তিষ্ক ভরাট করে ফেলছি।“ভারতীয়সহ বিদেশের নানা স্থানের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানে বাংলেদেশের নিজস্ব সমাজ, কৃষ্টি-কালচার নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে”; “আমাদের নতুন প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে”, ইত্যাদি বাগাড়ম্বরে প্রতিদিন ক্লাসরুম গরম করছি। দিনভর জ্ঞান বিতরণ করে বাসায় ফিরে দেখি আসছে পহেলা বৈশাখে দু’বছরে পা দিতে যাওয়া আমার ছেলে শেখ নাফিম ‘শিবা’ ‘শিবা’ করছে।
‘শিবা’ হিন্দি ভাষা মাধ্যমে নির্মিত নতুন একটি কার্টুন সিরিয়াল। গল্প অসাধারণ কিছু না। কিন্তু বানানো শৈলী খুব চিত্তাকর্ষক। শিবা তার বীরোচিত মুভমেন্ট, দেহভাষা, সংলাপ আর বিভিন্ন সংকটে সাহসী উপস্থিতি দিয়ে আমার ছেলের মতো বাংলাদেশের অনেক শিশুর মস্তিষ্কে অনুরণন সৃষ্টি করেছে। শিবা যখন তার সাইকেলে চড়ে বড় বড় সন্ত্রাসী বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার পথে ভিলেনকে ফ্লাইং কিক দেয়, আমার ছেলে তখন হাত তালি দিয়ে উঠে। সন্তানের মিষ্টি হাততালি দেখতে আমার ভালো লাগার কথা। কিন্তু শিবার কারিশমায় ছেলের হাত তালি আমার ভালো লাগে না। কারণ ভাষা আর চরিত্রটির নাম। আমার ছেলে এ বয়সে কেন শিবার নাম বলতে শিখবে। আমার সংস্কৃতি বা ধর্মের শব্দ এটি না। আমি ছেলেকে কিছু বলতে না পেরে টেলিভিশন বন্ধ করে দিই। কিন্তু টেলিভিশন সেট বন্ধ করে দিয়ে কি শেষ রক্ষা হবে? সারাক্ষণ টেলিভশন বন্ধ রাখা যাবে না। টেলিভিশন এক অনিবার্য শক্তির নাম যার প্রতি সাড়া না দিয়ে উপায় নেই।
শুধু আমার ঘরে না, বাংলাদেশের প্রায় সব ঘরেই সব বয়সের মানুষের বিনোদনের টেলিভিশন উপাদানের সিংহভাগ যে বিদেশী, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। বস্তি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ; সর্বত্র বিনোদনের প্রধান উপকরণ হিন্দি এবং ভারতীয় গান ও সিনেমা। যেসব ছেলে-মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে অথবা যারা পশ্চিমা মানদণ্ডে ‘আধুনিক’ হতে চান তাদের মনোজগতে আবার পশ্চিমা নানা চরিত্র ও সংলাপ ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশের টেলিভিশন মাধ্যমে বয়সভিত্তিক চিত্তাকর্ষক বিনোদনধর্মী অনুষ্ঠানের অভাব, প্রায় সবগুলো চ্যানেলে একই রকম সংবাদ প্রচার, টক শো ও নিম্নমানের বিজ্ঞাপন-নির্ভরতা; অন্যদিকে হিন্দি ও ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর বয়স ও বিষয় ভিত্তিক নানা মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান, পরিমিত কিন্তু মান সম্পন্ন বিজ্ঞাপন প্রচার ইত্যাদি কারণে আমার মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আর ভেতর থেকে কাজ করেছে ভাষা হিসেবে বাংলা ও হিন্দির শাব্দিক ও অর্থগত মিল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সমজাতীয়তা। বেশির ভাগ মানুষের ইংরেজি বুঝতে পারার ক্ষমতা না থাকায় বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ইংরেজি অনুষ্ঠানগুলো গণহারে প্রিয়তা পায়নি, কিন্তু আমরা তো জানি, শিক্ষিত শ্রেণীর বাংলাদেশিদের মাঝে ইংরেজি শিক্ষার কী রকম প্রাণান্ত প্রয়াস বিদ্যমান। জন্মদিন, বিয়ে, পূজা, এমনকি ঈদ উদযাপনে বিনোদনের প্রধান উপকরণ হয়ে পড়েছে হিন্দি ভাষাযোগে নির্মিত গান। হিন্দুদের পুজা উদযাপনে গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সর্বশেষ লক্ষ্য করলাম স্বরস্বতি পূজার দিন।
হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের একটা শব্দ বাংলাদেশীদের মাঝে খুব প্রিয়। শব্দটি হল ‘আইটেম সং’। যৌনতা উস্কে দিতে যতখানি সম্ভব ছোট এবং বিকৃত ডিজাইনের কাপড় পরিহিত একজন দক্ষ নারী তার দলবল নিয়ে নর্তন-কুর্দন করে আমাদের প্রায় সব বয়সের মানুষকে ‘মজা’ দেন এই আইটেম সংগুলোর মাধ্যমে। যতটুকু জানি, স্বরস্বতি বিদ্যার দেবী। বিদ্যার পাশাপাশি সঙ্গীতের দেবীও তিনি। ছোটবেলায় গ্রামে দেখেছি, স্কুলে পূজার মণ্ডপে হিন্দু বন্ধু-বান্ধবীরা দেবীর পায়ের কাছে পাঠ্য বই এনে রেখেছে। মাইকে দারুন আবেগি বাংলা গান বাজছে। আমরা গিয়ে পূজার প্রসাদ খেয়ে অমৃতের স্বাদ নিয়ে সারাদিন বিশেষ ভালো লাগায় ঘুরে বেড়াতাম। দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে আমাদের বন্ধুরা পড়ালেখায় দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে সামনের পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেই পূজার সাথে বর্তমানের পূজার অনেক কিছু মেলাতে পারি না।
আমার ছাত্রছাত্রীরা এবারই প্রথম বিভাগের পক্ষ থেকে পূজার আয়োজন করেছিল। ছোট বিভাগ, ছোট মণ্ডপ। গুলিস্তান-ধামরাই বাসে করে ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি লগ্ন চলে যাওয়ার উপক্রম, ব্রাহ্মণ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিক-সেদিক ফোন করে যখন ব্রাহ্মণ পাওয়া গেল, তখন লগ্ন যায় যায় অবস্থা। অবশেষে ব্রাহ্মণ ‘দেব’ এসে যখন আমাদের রক্ষা করলেন ততক্ষণে অনেক পূজারী প্রসাদ ছাড়াই মণ্ডপ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেছেন। মণ্ডপ সাধারণ হলেও যে গান বাজছিল তার সবগুলোই ছিল অসাধারণ। পূজার ট্র্যাডিশনাল বাংলা গান ছাড়াও রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতিও বাজছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আড্ডা দেয়ার এক ফাঁকে কানে আসল হিন্দি ‘নাগিন নাগিন’ গানটি। একজন বলল প্রতিবেশী অনুষদের একটি বিভাগের মণ্ডপে বাজছে গানটি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীতেই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে অন্য জায়গায় না জানি কী হয়? পূজার দিনে পূজা মণ্ডপে ‘নাগিন’ ‘নাগিন’ কিংবা “মুন্নি বদনাম হোয়ে’ টাইপের গান শুনে আমরা অভ্যস্ত না। বিদ্যার সাথে এ জাতীয় আইটেম গানের কি কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের কারোরই এই বিকৃত চর্চা সহ্য হওয়ার কথা না। তার উপর ভাষার মাসে লাউড স্পিকারে অন্য একটি ভাষার অশ্লীল গান বাজানো কোনোভাবেই সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। একজন বাঙ্গালী মুসলমান হিসেবে পূজা নিয়ে আমার এই কথাবার্তা অনেকের ভালো লাগবে না বিধায় বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দ পূজার দিনে হিন্দি আইটেম গান বাজানোর বিষয়টি কতটুকু উচিত তা বিবেচনা করলে ভালো হবে। তাছাড়া ধর্ম ও সংস্কৃতি মন্ত্রনালায়ের এ বিষয়ে বিশেষ করণীয় আছে বলেই আমার ধারণা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৫ বছর। স্বাধীনতা অর্জন কিংবা ধরে রাখার প্রক্রিয়া কখনই সহজ ছিল না আমাদের জন্য। স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, ২ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন; জাতির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের বেছে বেছে হত্যা করেছে শত্রুরা। স্বাধীনতার পর ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, একই সালের ৩ নভেম্বের চার নেতাকেও হত্যা করা হয়। তারপর দীর্ঘ অমানিশা। স্বাধীনতা বিরোধীরাই আবার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। অবশেষে ৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করে। এরপরেও কিছু কিছু বড় বাধা এসেছে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রা (?) অব্যাহত আছে। এই প্রশ্নবিদ্ধ অগ্রযাত্রার গুণগত অবস্থাটা কী?
বিদেশী অনুষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে, হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ অনুষ্ঠানের মান এবং এগুলোর বৈচিত্রহীনতা দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের গণমাধ্যম অভিভাবকরা গণমাধ্যমের এর প্রকৃত শক্তি কতটুকু অনুধাবন করতে পেরেছেন? নেতিবাচক এবং গতানুগতিক সংবাদ, প্রতিদিনের ঘটনা-নির্ভর টকশো, বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি, গবেষণা-বিহীন নাটক- সিনেমা, পপুলার অথবা এলিট কালচারের কোনোটার শক্তিকেই বাণিজ্যিকভাবে অনুধাবন করতে না পারার যে বাস্তবতা তার সঠিক অনুধাবন খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। আমাদের সন্তানদের জন্য কোনো দেশীয় জনপ্রিয় কার্টুন প্রোগ্রাম নেই। টেলিভিশনে শিবা, ডোরেমন আর পাখি, বইয়ের পাতায় সিনড্রেলারাই আমাদের সমাজে জনপ্রিয়। আমাদের বাচ্চারা মনের অজান্তে হিন্দি কথা বলে উঠে। তাহলে রফিক, জব্বারদের আত্মদানের কী দরকার ছিল?
ইত্যাদির হানিফ সংকেত কিংবা মাটি ও মানুষ’র শাইখ সিরাজ’রা যেদিন থাকবেন না তখনকার অবস্থা কল্পনা করে আমি শিউরে উঠি। আবার পরক্ষণে আবার আশায় বুক বাঁধি যখন দেখি আমাদের নতুন প্রজন্ম হিরোস অফ সেভেনটি ওয়ান নামে ভিডিও গেমস তৈরি করছে। আজ ভাষার মাসে কেবলই মনে হচ্ছে, গণমাধ্যমের প্রকৃত শক্তি অনুধাবন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, গণমাধ্যম শুধু মাত্র নেতিবাচকতা আর উদ্বেগ ছড়ানোর মেশিন না, গণমাধ্যম হতে পারে ইতিবাচকতা আর সমৃদ্ধির পথে সমাজ পরিবর্তনের যাদুর কাঠি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)