একটা সময় ছিলো যখন আমাদের বাবা-মা আমাদের সরকারি স্কুলে পড়তে পাঠাতেন। পুরো দেশে দুই একটি বলার মতো বেসরকারি স্কুল ছাড়া প্রায় সব ভালো স্কুল বলতে সরকারি স্কুলগুলোকেই বোঝানো হতো। সেই সময়ের পরিবর্তন হলো। দেখা গেলো বিশেষ করে শহর অঞ্চলে সরকারি স্কুলগুলো, বেসরকারি স্কুলগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়লো। এমন কি মফঃস্বল কিংবা গ্রামেও এখন বেসরকারি স্কুলগুলো ভালো করছে।
ছেলে মেয়েদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করাতেই হবে এই ধারণা বাবা মায়েরা অনেক আগেই ত্যাগ করেছেন। স্কুলের বেতন যদি কষ্ট করেও জোগাড় করতে হয়, তাও বাবা মা চান একটা ভালো স্কুলে যাতে তার সন্তান পড়ে! অনেকের পক্ষে হয়তো শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়না আর্থিক বিষয়টি বিবেচনা করে, কিন্তু যারা শেষ পর্যন্ত পেরে উঠেন তাঁরা কিন্তু ঠিকই ভালো একটা স্কুলেই সন্তানদের পাঠান।
দুই দশক আগেও ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে পড়াশুনা বলতে দেশের মানুষ সরকারি কলেজগুলোকেই বোঝাতো। এর মাঝেও দেশ সেরা দুই একটা বেসরকারি কলেজ হয়তো ছিল কিন্তু সেগুলো ঢাকা কিংবা বড় জোর চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন দেখা যাবে বেসরকারি কলেজগুলো দেশ সেরা কলেজের তালিকায় সরকারি কলেজ গুলোকে ছাপিয়ে গেছে।
স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে এখন আর সরকারি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঝে সেই অর্থে তেমন পার্থক্য নেই; বরং যাওবা আছে সেটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন পিছিয়ে পড়ছে সে নিয়ে আলোচনা!
স্কুল ও কলেজ পেরিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যায়। একটা সময়ে বাংলাদেশে থার্ড লেভেল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বলতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বোঝাতো। প্রায় দুই দশক আগে যখন দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট আসে তখন দেশের বেশীরভাগ মানুষের মাঝেই একটা ধারণা ছিল, সেখানে তো আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের লোকজনই পড়বে!
যে কোনো কনসেপ্ট কোনো সমাজে প্রথম প্রয়োগ করলে তা সম্পর্কে নানা আলোচনা, সমালোচনা, মতামত আসবে সেটাই স্বাভাবিক। যেহেতু কড়া অংকের বেতন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে পড়াশোনার কনসেপ্ট এই সমাজে ছিল না তাই হয়তো সবাই ধরেই নিয়েছিলো কারাই বা সেখানে যাবে শুধুই টাকা খরচ করে পড়তে!
সময় গড়িয়েছে, দেশের সরকারি স্কুল কলেজগুলোর পাশাপাশি যেমন বেসরকারি স্কুল কলেজগুলো এখন ভালো করছে; সেই ভালো করার একটা প্রতিফলন হচ্ছে বিশাল পরিমাণে ছাত্র-ছাত্রীর প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে পড়াশোনার জন্য বের হওয়া। আর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের সঙ্কুলান যেমন হয় না, ঠিক তেমনি এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষাও দিচ্ছে। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যই প্রয়োজন আছে আমাদের সমাজে।
এমন অনেকেই আছে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দ করছে একটি মান সম্মত শিক্ষার পাশাপাশি দ্রুত পাশ করে বের হয়ে চাকরি বাজারে ঢুকে পারিবারে নিজেদের অবদান রাখার জন্য। এদের বেশীরভাগই হয়তো অতি সাধারণ পরিবার থেকেই উঠে আসা। যেমনটা এখন খুব স্বাভাবিক বেসরকারি স্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রে।
গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের টিউশনফি’র উপর ভ্যাট আরোপ! যেই দেশে এখনো বিশাল একটা জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, যেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা নিতে আসা ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় অতি নগণ্য; সে দেশের সরকার কী ভেবে শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ করেছে সেটা বোধগম্য হচ্ছে না!
“সরকারি শিক্ষা”, “বেসরকারি শিক্ষা” বলে তো আর কিছু নেই। শিক্ষা তো কোন প্রসাধনী নয় কিংবা কোন বিলাস দ্রব্য নয় যে এর উপর কর আরোপ করতে হবে।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আগের চাইতে অনেক ভালো করছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো বাজে কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তবে বেশীরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব ছাত্র ছাত্রী পড়ছে তারা কিন্তু ঠিকই পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে; নিজেদের পরিবার ও সমাজের জন্য অবদান রাখছে।
শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এখন পড়তে যায় এবং ভালো নজিরও ক্ষেত্রে বিশেষে স্থাপন করছে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট মাত্র দুই দশক আগে এসছে। এর মাঝেই কিন্তু তারা একটা অবস্থান করে নিয়েছে। এখন এভাবে তাদের শিক্ষার উপর কর আরোপ করলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেই আসলে এক অর্থে অবহেলা করা হয়। একটা সময় হয়তো আসবে যখন স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যেমন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে গিয়েছে, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনীতিতে নিজেদের অবদান রাখবে। আর সেটি হলে তো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক।
একটা বিষয় কিন্তু মনে রাখতে হবে, একজন ছাত্র তা সে সরকারি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানেই পড়ুক, পড়া শেষে করে কিন্তু দেশের অর্থনীতিতেই সে অবদান রাখে। এ ছাড়া অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা দেশের বাইরে চলে যায় পড়াশোনা শেষ করে।
এই বিষয়টি কতটুকু সত্য, সেটি ভাবনার বিষয়; তবে যদি সেটি সত্যও হয়ে থাকে; তাহলেও তো তাঁরা দেশের অর্থনীতিতে ভালো অবদান রাখছে। তারা নিশ্চয়ই দেশের বাহিরে গিয়ে একটা না একটা সময় চাকরি করছে কিংবা কিছু না কিছু তো করছে। আর সেটি যদি করেই থাকে, তাহলে তো তারা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে। এটিও তো দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার শামিল।
এর মানে হচ্ছে এই ছাত্র ছাত্রীর তো কিছুটা হলেও দেশের প্রতি অবদান রয়েছে। তাই শিক্ষাতে ভ্যাটের বিষয়টি সরকারের উচিত হবে আরেকবার ভেবে দেখা!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)