ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার যা হলো সেটা নেহায়েতই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যাওয়া শিক্ষকদের একাংশের সিনেটের বিশেষ অধিবেশন স্থগিতের জন্য ২৪ জুলাই আদালতের রিট আবেদন ও রায় পাওয়া, সেই রায় চেম্বার বিচারপতি কর্তৃক স্থগিত করে ৩০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করার পরেও ২৯ জুলাই তড়িঘড়ি করে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠান এবং মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে বর্তমান ভিসিসহ তিনজনের উপাচার্য প্যানেল সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত করা সবই দীর্ঘ সাড়ে চার দশকের বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নষ্ট রাজনীতির অংশমাত্র।
শিক্ষার্থীদের অধিকার আছে ডাকসু নির্বাচন দাবী করার। কারণ সিনেটে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার তাদের আছে। ডাকসু নির্বাচন করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। প্রায় সাড়ে আট বছর ধরে বর্তমান ভিসি এই পদে আছেন। এই সময়ে তিনি ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করার মতো যথেষ্ট সময় পেয়েও নির্বাচন দেননি। এটা যদি শিক্ষার্থীরা বলে সেটাকে অন্যায় বলা যাবে কি? বর্তমানে, ১০৫ সদস্যের সিনেটে ৫০টি পদ শূণ্য রয়েছে। বাকি ৫৫ সদস্যের মধ্যে শনিবারের সভায় ৪৭ জন যোগ দেন।
কয়েকটি বাম রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই ডাকসু নির্বাচন না দিয়ে সিনেটের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠানের বিরোধীতা করে আসছিল। শনিবার তারা সভা শুরুর আগে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে সিনেট ভবনের গেটে সমবেত হয়। সিনেট সদস্যরা তাদের সামনে দিয়েই সিনেট ভবনে গিয়েছেন সভা করার জন্য। এসময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের হাতে থাকা ফেস্টুনের বক্তব্যে শ্লোগান দিতে থাকে- ‘সিনেটে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি কোথায়?’, ‘আগে ডাকসু পরে ভিসি’, ‘ছাত্র প্রতিনিধিবিহীন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন মানি না’ ‘ডাকসু ছাড়া ভিসি নির্বাচন মানি না, মানব না’, ‘সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি চাই’, ‘অবৈধ ভিসি প্যানেল মানি না’, ‘রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন চাই’ ইত্যাদি। সিনেট সদস্যরা ভবনে পৌঁছার পর গেট আটকিয়ে দেওয়া হয়। কিছু শিক্ষক ভবনের বাইরে অবস্থান করছিলেন যাদের মধ্যে বহিরাগত শিক্ষক ছিলেন বলেও জানা যায়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের হাতাহাতি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যে, শিক্ষকগণ কোন ছাত্রের ঘাড় ধরে রেখেছেন, কারো হাত কিংবা জামা ধরে টানছেন। এমনকি ছাত্রীদের গায়েও হাত তুলেছেন, যা নারী নির্যাতনের শামিল।
রোববার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ চায়ের আড্ডা সবত্রর্ই অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হাতাহাতি ও কয়েকজনের আহত হওয়ার ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সাড়ে ৮ বছর ধরে দায়িত্ব পালনের পরেও ডাকসু নির্বাচন না দেওয়ায় ভিসি আরেফিন সিদ্দিকীর কড়া সমালোচনা করেন। উল্লেখ্য যে, আগামী ২৪ আগস্ট বর্তমান ভিসির মেয়াদ শেষ হবে। ২০০৯ সালে তিনি প্রথমে সাময়িক নিয়োগ পান, পরবর্তীতে সাড়ে চার বছর পর ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট এরকমই একটি বিশেষ সিনেট অধিবেশনের মাধ্যমে তিনি ভিসি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারের যে তিনজনের প্যানেল তৈরি করা হয়েছে সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ একজনকে বেছে নেবেন। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা বর্তমান ভিসিই পুনরায় নির্বাচিত হবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদ-পদবী লাভজনক হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাকে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, পেশা পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসে তিনি এখন মানসিক কষ্টে আছেন। আলাপকালে তিনি জানান যে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে নীতি নৈতিকতা নেই। উদাহরণ হিসেবে বলেন যে, কোন একটি প্রকল্পের অর্থায়নে কয়েকজন শিক্ষকের স্টাডি ট্যুর ছিল থাইল্যান্ডে কিন্তু নির্বাচিত শিক্ষকদের মধ্যে ৪ জন ভিসা না পাওয়ায় থাইল্যান্ডে যেতে পারেননি। কিন্তু তারা থাইল্যান্ডে থাকা খাওয়ার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দাবী করেন। যা শেষপর্যন্ত দিতে হয়েছিল। আর মিটিংয়ে না এসে সম্মানী নেওয়া তো সাধারণ ঘটনা। তিনি আরো বলেন, আরো বড় বড় আর্থিক দুর্নীতিতে শিক্ষকরা হরহামেশা যোগ দেন ও আর্থিকভাবে লাভবান হন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতাত্তোরকালে ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগের ভর্তি হওয়া কুমিল্লা জেলা স্কুলের শিক্ষার্থী মি. শওকত আহসান ফারুক ফেসবুকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত “রুম নাম্বার ১৪৬” লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন- “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিলো চরম সংকটে। পারমিট, রেশন, কাপড়ে জন্য লাইন, খাবারের জন্য লাইন, রাজনীতিতে হানাহানি চলছে। ছাত্র সমাজের বৃহৎ অংশ পড়াশুনা বাদ দিয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত। চলছে নৈরাজ্য, নৈতিকতার অবক্ষয়।” আমি তার কাছে ফেসবুকে জানতে চেয়েছিলাম “”ছাত্র সমাজের বৃহৎ অংশ পড়াশুনা বাদ দিয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত।”- আপনার লেখার এই বাক্যটিতে ছাত্র সমাজের বড় অংশ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েছে লিখেছেন। এটা কি ভুল করে লিখেছেন? আপনি কি ক্ষুদ্র অংশ লিখতে গিয়ে ভুল করে বৃহতৎ লিখেছেন? জানাবেন আশা করি।” জবাবে তিনি নিশ্চিত করে লিখেছিলেন, “বড় অংশই। পড়াশুনা বাদ দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের সমসাময়িক যারা ছিলো।”
অনৈতিক ও অছাত্রসুলভ কাজের এই ধারা সময়ের ধারাবাহিকতায় আরো বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যারা শিক্ষক নেতা তাদের অনেকেই সত্তর দশকে শিক্ষার্থী ছিলেন। যাদের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও হয়েছেন। ফলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে নৈতিকতার তীব্র অধঃপতন দেখতে পাই সেটা দীর্ঘদিনের চর্চার ফল। শিক্ষকদের হাতে শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ নির্যাতন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যেমন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের দল হলো সাদা। আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকদের দল হলো নীল। বর্তমানে সিনেটে সাদা দলের সদস্য রয়েছেন ২ জন। তারা শনিবারের সভায় যোগ দেননি। আগেই তারা যোগ না দেওয়ার কথা বলেছেন, কারণ হিসেবে তারা দাবী জানিয়েছেন ২৫ জন গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনের আগে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করা যাবে না। এদিকে ক্ষমতাসীন দলের চিরায়ত কোন্দল থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের শিক্ষকরাও। গত মে মাসে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে নীল দল দু’টি অংশে ভাগ হয়ে আলাদা প্যানেল দেয়। এতে ভিসিপন্থীদের শেষ পর্যন্ত জয় হয়। বিরোধীরা আদালতের শরণাপন্ন হতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তারা আদালতে যাওয়া থেকে বিরত হয়। কিন্তু গত ২৪ জুলাই নীল দলের সেই বিরোধী পক্ষের ১২ জন শিক্ষক ও ৩ জন রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট রেজিস্টার্ড প্রতিনিধি নির্বাচনের আগে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডাকায় আদালতে রিট আবেদন করেন। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে অধিবেশন ডাকার চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত করলেও দুই দিন পরে চেম্বার বিচারপতি স্থগিতের আদেশ স্থগিত করে ৩০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
এর মধ্যেই ২৯ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সংশ্লিষ্টরা পত্রিকায় সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছেন যে, সিনেটের শূণ্যপদগুলো পূরণ করে তবেই উপাচার্য নির্বাচন প্যানেল করা উচিত ছিল। বর্তমানে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি, অধিভুক্ত কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের প্রতিনিধি, গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধি, একাডেমিক পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সিনেটে নেই। প্রায় ৫০ ভাগ প্রতিনিধির পদ শুণ্য। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে শূণ্য পদগুলো পূরণ করে ভিসি নির্বাচন করা হলে সেটা একটা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সঠিক পদক্ষেপ হতে পারত। যদিও বলা হচ্ছে যে, যেভাবে ভিসি প্যানেল নির্বাচন করা হয়েছে সেটা আইনের ব্যত্যয় ঘটায়নি। কিন্তু এই ধরণের পদক্ষেপকে সুযোগসন্ধানী পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা রেখেছিল এবং এক পর্যায়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যৌথ আন্দোলনে। কিন্তু তারপর থেকে গত ২৭ বছরে ডাকসু নির্বাচন আর হয়নি। গত শনিবার শিক্ষার্থীরা ভিসি প্যানেল নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচনের দাবীই জানিয়েছিল। সেখানেই হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনা তদন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিন সহকারী প্রক্টরের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
তবে অভিজ্ঞমহল মনে করেন যে, এই ধরনের তদন্ত দিয়ে যে কারণে এই ধরণের হাতাহাতির ঘটনা ঘটল তার স্থায়ী সমাধান হবে না। স্থায়ী সমাধান নিহিত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির নামে অনৈতিক কাজে লিপ্ত না হওয়ার মধ্যে। আর এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে পেতে পারে তার হারানো গৌরব। যে গৌরবের কথা আজো অনেকে বলে থাকেন, যা বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)