চৈত্র মাসের তপ্ত খাঁ-খাঁ রোদের মধ্যে মাঠে কৃষকের কাজ করার দৃশ্য গ্রাম বাংলার চিরাচরিত ইতিহাসে মর্যাদার আসনে আসীন। এমনি এক তপ্ত দুপুরে এক কৃষক বাবা ধান গাছ নিড়ানি দিচ্ছেন। ক্লান্ত, কর্দমাক্ত, পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে কাজ করতে করতে দুপুরের সময় ঘনিয়ে আসে। স্বাভাবিক ও প্রথাগত নিয়ম মেনেই বাড়ি থেকে বাক্সবন্দি করে মাঠে খাবার পাঠানো হয় ছেলের হাত ধরে। দূর থেকে ছেলের আসা দেখে বাবা ছেলেকে ধানক্ষেতে যেতে বারণ করে গাছের ছায়ায় বসার জন্য নির্দেশ প্রদান করে থাকেন যাতে রোদের সংস্পর্শে ছেলেকে যেতে না হয়। বাবার উদ্দেশ্য হচ্ছে ছেলেকে যেন কোনভাবে রোদে পুড়তে না হয়, বাবার শত কষ্ট হলেও ছেলেকে তিনি নিরাপদে রাখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। জীবনে ছেলেকে যাতে কোনরূপ কষ্ট সহ্য করতে না হয় সে ব্যাপারেও বাবারা যথেষ্ট আগ্রহী, সচেতন ও সদিচ্ছা নিয়ে ছেলে-মেয়েকে প্রকৃত মানুষ করার চেষ্টা করেন। বাবারা শত অভাব অনটনেও হাসিমুখে ছেলেমেয়েদের সামনে নিজের সর্বোচ্চটা বিলিয়ে দেবার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে বাবাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়, প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তবান পরিবারের বাবাদের বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। আমরা ছেলেরা ভুলে যায় বাবার সংগ্রামের জীবন, আমাদের প্রতি বাবার দায়িত্ববোধের কথা, সন্তানদের জন্য বাবার সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষার কথা। আমাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা সামান্য স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে দ্বিধা করি না অথচ আমরা ভুলে যায় তাদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছি, সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি।
একটি সন্তানের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে বাবা মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য, বাবা মায়ের নিরলস প্রচেষ্টা ছাড়া কোন সন্তানের পক্ষে মানবিক মানুষ তথা সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। কাজেই, সন্তানের পূর্ণ বিকাশের জন্য মায়ের পাশাপাশি বাবার ভূমিকাও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী মা দিবসকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয় বাবা দিবসের বেলায় তেমনটা লক্ষ্য করা যেত না। তবে কালের বিবর্তনে বাবা দিবসকেও বেশ ঘটা করে পালন করা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী জুন মাসের ৩য় রোববার বাবা দিবস পালন করা হয়, আমাদের বাংলাদেশেও সে নিয়মটা অনুসরণ করা হয়। জীবিত থাকা বাবারা যেন কোন রকম অবহেলায় দিনাতিপাত না করে সে বিষয়টিও সকলের বিবেচনায় নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
আর যাদের বাবা নেই তারা প্রতি পরতে পরতে বাবার অভাব অনুভব করে থাকেন। আসলে যার নাই সেই-ই শুধু না থাকার বেদনা অনুভব করে থাকেন অন্যরা কখনোই সে বিষয়ে দৃষ্টিগোচর হন না। যাদের বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন এমন প্রত্যেক সন্তানের বাবার সঙ্গে নানারকম স্মৃতিকাতরতার আবির্ভাব ঘটে থাকে, উদ্ভব ঘটে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বাবার সংগ্রামের কথা, ভেসে উঠে জীবন সংগ্রামে চলার পথে উদ্ভূত নানা বাধা-বিপত্তির প্রসঙ্গ। স্মৃতি রোমন্থনে আমরা যেমন পুলকিত হই ঠিক তেমনিভাবে যাদের বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন তাদের মধ্যে বাবার প্রতি অস্ফুট বেদনার বহি:প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া সকলের বাবার আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি, সকলেই যেন সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপা পায়। এ নিবন্ধে মধ্যবিত্ত সংসারে শিক্ষক বাবার জীবনাচরণ, চলন বলন, সামাজিক কর্তব্যবোধ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে ভূমিকা গ্রহণ, আত্নীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ, সামাজিক মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অন্যতম পূর্ব শর্ত হলো সামাজিকীকরণ। মূলত এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সমাজে বসবাস করার সুযোগ পায় এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে পরিবার। বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিবারের শিশু সদস্যদের সুসম্পর্ক বজায় থাকলে একটি ছেলে/মেয়ে খুব সহজেই সামাজিক মানুষ হিসেবে বড় হওয়ার হাতেখড়ি পায়। কাজেই বলা যায়, পরিবারের কর্তা ব্যক্তি হিসেবে বাবার অনন্য ও সাহসী ভূমিকা সন্তানদের সুসন্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
এবার আসি আমার বাবার গল্পে, মরহুম আমান উল্লাহ মাস্টার; আব্বা মনে হয় ৮০ এর দশকে গ্রামের হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তখনকার সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকতা পেশার আলাদা বিশেষত্ব যেমন ছিল ঠিক তেমন শিক্ষকদেরও মধ্যে ছিল মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষ করার স্বপ্ন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ছিল চোখে পড়ার মতো এবং শিক্ষার্থীরা ভয় আর ভাললাগায় শিক্ষকদের সম্মান আর শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন রেখেছিলেন। আমিও আব্বার গণিত ক্লাসের শিক্ষার্থী ছিলাম, বুঝানোর যে কৌশল তিনি ছাত্রদের রপ্ত করতে শিখিয়েছিলেন সেটি আজও আমি আমার শিক্ষার্থীদের বলার চেষ্টা করে থাকি। তিনি জোরের সাথে বলতেন, খুব বেশি পড়ার দরকার নেই তবে এমনভাবে পড়তে হবে যেন যে বিষয়টি আত্মস্থ করবে সেটি যেন সারাজীবন মনে থাকে। যে কথাটি তিনি বিশেষভাবে বলতেন সেটি হলো অংকের নিয়ম এবং কৌশল এমনভাবে আত্মস্থ করতে হবে যেন পরবর্তীতে ঐ গণিত নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তরটি সহজভাবে দেওয়া সম্ভব হয়।
আব্বার সঙ্গে আমার জীবনের একটি বিরাট সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছে যে কারণেই খুব বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। উনার মৃত্যুবার্ষিকী এলে চোখের সামনে হাজারটা স্মৃতি এসে বিয়োগান্তক করে তুলে। ২০১০ সনের ৩১ জানুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন, দেখতে দেখতে ১১টি বছর চলে গেলো আমার শিক্ষক বাবাকে ছাড়াই। গ্রামের স্কুলে আগে বোর্ডিং সিস্টেম চালু থাকতো বিশেষ করে ৫ম শ্রেণি ও ৮ম শ্রেণির বৃত্তিকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতার বার্তা বহন করতো গ্রামের স্কুলগুলোতে। সে সুবাদেই প্রাইমারির বৃত্তি পাওয়ার পর আব্বা ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে বোর্ডিং এ রাখলেন আমাকে, টানা দশম শ্রেণি পর্যন্ত বোর্ডিং এ ছিলাম। আব্বার অনুপ্রেরণা, উৎসাহ, ধরিয়ে ধরিয়ে পড়ানোর কারণে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তির অধিকারী হয়। লেখার সময় প্রথম লাইন কিভাবে সোজা রাখতে সে কৌশল আব্বাই শিখিয়েছেন, কেননা প্রথম লাইন সোজা থাকলে পরের লাইনগুলো অটোমেটিক সোজা হয়ে যায়। বানান নির্ভুল লেখা, লেখা সুন্দর করা, দ্রুত লেখার অভ্যাস করা ইত্যাদি বিষয়গুলো আব্বা যথাসাধ্য শেখানোর চেষ্টা করেছেন। জোরের সহিত বলতে চাই, আব্বা শুধু নিজের সন্তানকে শুধু নিবিষ্টচিত্তে পড়ার বিষয়ে তাগিদ দিতেন না, স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনি নিজের সন্তান হিসেবেই মূল্যায়ন করতেন। এককথায় বললে যা দাঁড়ায় তা হলো, আব্বার অনেক শিক্ষার্থীর ন্যায় আমার আজকে যা অবস্থান তার পিছনে শিক্ষক এবং অভিভাবক হিসেবে আব্বার অবদান অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য, আব্বা কিন্তু তার অজস্র ছাত্র/ছাত্রীর জন্য এহেন কাজগুলো অবলীলায় সম্পন্ন করতেন।
বাবা মানে একটি শব্দের প্রকাশ নয় মাত্র, বাবা হচ্ছে একটি অনুভূতি, আস্থা ও ভরসার আশ্রয়স্থল। সন্তানের যে কোন বিপদে আপদে বাবাই বুক চিতিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবাদের আদর্শ, নীতি, ভাললাগা, মানবিকতা, পছন্দ/অপছন্দ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সন্তানদের মানবিক ও মানসিক উন্নয়ন ঘটে থাকে। একটা সময় গ্রামে মুক্ত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মঞ্চ নাটকের ব্যাপক প্রচার ও জনভিত্তি ছিল।
আব্বা মঞ্চ নাটকে যেমন অভিনয় করতেন ঠিক তেমনিভাবে নাটক নির্দেশনা দিতেন শক্ত হাতে। আব্বার অসংখ্য শিক্ষার্থী তৎকালিন সময়ে তার নির্দেশিত নাটকে অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। এখনো সে সুনামের ফল্গুধারা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে বিরাজ করে। আব্বার অভিনয় করা অসংখ্য নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক হলো গরিবের আর্তনাদ, মা হলো বন্দী, বর্গী এলো দেশে, মুঘল এ আজম, নবাব সিরাজউদদৌলা, আপন দুলাল, জীবন্ত কবর, আনারকলি, কাশেম মালার প্রেম সহ অসংখ্য দর্শকপ্রিয় নাটকে শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে মঞ্চনাটকে দর্শকের গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছেন। আব্বার শিক্ষকতার সময়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে মঞ্চ নাটক নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নিজেদের সম্পৃক্ত করে প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতেন। আব্বার দেখানো পথেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নাট্য সংগঠনের সঙ্গে যেমন সম্পৃক্ত থেকেছি ঠিক তেমনিভাবে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ও করেছি।
আব্বা শিক্ষক হলেও আমরা কৃষিভিত্তিক পরিবারে বড় হয়েছি। আব্বা পুরোদুস্তর কৃষকও ছিলেন, পরিবারের খরচের টাকার অধিকাংশ আসতো কৃষিকাজ হতে। সাপ্তাহিক হাটের দিন ধান বিক্রি করে আমাদের বাজার করার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। বাজার করার সময় কোন জিনিসের প্রতি খুব আকর্ষণ বোধ করলে এবং আব্বার কাছে টাকার ঘাটতি থাকলে আয় বুঝে ব্যয় কর এ কথাটি বলে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। আব্বার এ শিক্ষাটি আমার ব্যক্তিক জীবনে খুব কাজে এসেছে এবং আমার জীবনের প্রতিটি জায়গায় ও কর্মকাণ্ডে আব্বার দেওয়া শিক্ষা খুব কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আব্বার যে দিকটি সবথেকে বেশি নাড়া দিত আমায় সেটি হচ্ছে, আব্বা বাড়ি বাড়ি যেয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করতেন এবং অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতেন। আত্নীয়স্বজনদের আপদে বিপদে নিয়মিত খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করতেন এবং বিপদাক্রান্তদের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করার প্রাক্কালে আমাদের সামনে দান করার চেষ্টা করতেন, জিজ্ঞেস করলে প্রতিউত্তরে বলতেন পরবর্তীতে তোমাদেরও যেন দান করার আগ্রহ হয় সে জন্যই তোমাদের সামনে দান করার প্রচেষ্টা মাত্র। আসলে আব্বার পুরো জীবনটাই আমাদের জন্য শিক্ষনীয়, চলন, বলন, শিক্ষা, সামাজিকতা, আত্মীয়তা প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে আব্বার জীবনাচরণ আমাকে উৎসাহিত ও জীবনমুখী করে তোলে। আব্বা যেদিন অসুস্থ হয় সেদিনও তিনি ধান বিক্রি করে বাজার করার পরে সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন। অসুস্থ হওয়ায় দ্রুতগতিতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির ১ দিন পরই আব্বা পরলোকগমন করেন। আব্বাকে স্মরণ করেই জীবনে চলার চেষ্টা করি এবং পাথেয় হিসেবে অনুসরণ ও অনুকরণ করি। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে আব্বার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং কায়মানোবাক্য প্রার্থনা করি সৃষ্টিকর্তা যেন আব্বাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ জায়গায় সমাসীন করেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)