গত সাড়ে ছয় বছরে শিক্ষা ক্ষেত্র সম্প্রসারণের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তা প্রশংসনীয় ও কার্যকরী। প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শতভাগ ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। শেখ হাসিনা এ দেশের উন্নয়নে শিক্ষা খাতে ব্যাপক সম্প্রসারণে সচেষ্ট রয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যখন ২০ দলের জ্বালাও-পোড়াও চলছিল, তখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সময়মতো বই দেয়া হয়েছে। এখানে সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
শিক্ষা সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নের জন্যও বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হলে প্রয়োজন হয় অর্থের। চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার আগে অর্থমন্ত্রী সাড়ম্বরে বিভিন্ন স্থানে ঘোষণা দিয়েছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে উনি অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবেন। তার এ ঘোষণা এমন সময়ে ছিল যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে আমাদের দেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
একদিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অধিক বরাদ্দ ও সুষ্ঠু ব্যবহার এবং অন্যদিকে শিক্ষকের মান-মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক বলে সফলতাও নিশ্চিত। তবে এক্ষেত্রে কিছু বিষয় উল্লেখ করা দরকার। প্রথমেই আসা যাক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের বিষয়টি। আমার কাছে মনে হয়, একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বর্তমান সরকারের অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পেছন থেকে ছুরি মারার মতো করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপের ব্যবস্থা করেছে। যদিও এটি দশ শতাংশের প্রস্তাব ছিল, তা হ্রাস করে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে, তবু বলা যায়, প্রশাসনের যারা ভ্যাট আরোপ করেছেন তাদের অনেকেই বাস্তবতা জানেন না।
কেননা অনেকেই প্রশাসনযন্ত্রে চাকরি করে নিজের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের এ দেশে পড়ান না বা বিদেশে পাঠান কিংবা দেশের উচ্চমূল্যের ২-৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ান। ফলে কাছ থেকে দেখা বাস্তবতা এরা বুঝেন না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ৬০-৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। জমি বিক্রি করে পড়ানোর নজিরও অহরহ পাওয়া যায়। ভর্তির সময়ই একটি হিসাব করে পড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়।
অতিরিক্ত ভ্যাট দেয়ার ব্যাপার কেবল ছাত্রছাত্রীরা নয়, প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার কৃষক থেকে শুরু করে শ্রমজীবী-পেশাজীবী তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে চিন্তিত। ঈদের আমেজ অনেকের কাছে নিরানন্দ হয়ে উঠেছে। এটি এক ধরনের চক্রান্ত। দেশের অগ্রযাত্রার রথকে পেছনে ঠেলে দেয়ার জন্য এমনটি হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার টিউশনি জুটে, ইংলিশ মিডিয়ামের ক্ষেত্রে ৭০০০ থেকে ১০০০০ টাকার টিউশনি জুটে।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা এবং ইংলিশ মিডিয়ামের ক্ষেত্রে ৮০০০ থেকে ১২,০০০ টাকায় টিউশনি জুটে। বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের টিউশনির রেটও বেশি। ভ্যাট আরোপ না করে যারা অসৎ উপায়ে বছরে ৮-১০ লাখ টাকা দিয়ে তার সন্তান-সন্ততিকে কোন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়াচ্ছেন তার অর্থের উৎস খুঁজে বের করা দরকার। এজন্য এনবিআরকে আরও তৎপর হতে হবে। কারণ শিক্ষা জাতির অগ্রগতির মূল সোপান।
শেখ হাসিনা২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট আছেন। ইতোপূর্বে ৯ মার্চ, ২০১৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মান বৃদ্ধির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী প্রদান করলেও তা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের মতো আন্তরিকতায় ইতোপূর্বে কোন সরকার এধরনের প্রয়াস গ্রহণ করেননি। ৭৫ পরবর্তী পর্যায় থেকেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবহেলিত ছিলেন। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকার বেতন-ভাতাদি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। দেশে অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো জরাজীর্ণ।
সরকার সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করছে নতুন পে-স্কেল ঘোষণার জন্য। কিন্তু যারা পে-স্কেল প্রণয়ন করেছেন এবং এটি কার্যকর করার জন্য কাজ করেছেন তারা বারবার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবহেলা করেছেন। ৮ জুলাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ অব্যবস্থা দূর করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী ইতোপূর্বেও এ মর্মে ডিও লেটার ইস্যু করেছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন-ভাতাদি আসলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের গুরুত্বকেই বোঝায়। কেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের চক্রান্ত হচ্ছে, পরিবেশ অসন্তুষ্ট করার প্রয়াস গ্রহণ করা হচ্ছে তা সরকার ভেবে কার্যকরী সমাধানের পথ দেখাবেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করা দরকার। আজ যাদের অদূরদর্শিতার কারণে পে-স্কেল তৈরির সময়ে ঘাপলা হয়েছে তারা বর্ণচোরা, তারা বারবার রং পাল্টায়। এই সুবিধাবাদী গোষ্ঠী যত না সরকারের মুখে সাপোর্ট করে অন্তরে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং কায়েমী গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধি করে। এই মুখোশধারীদের হাতে রাষ্ট্রের অগ্রগতি যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে গেলে অবশ্যই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
জিডিপির পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার এবং তা সত্যিকার অর্থে কার্যকরভাবে ব্যয়িত হওয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের যোগ্য নেতৃত্বগুণে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গ্রামে-গঞ্জে বিস্তৃত হয়েছে তার ঢেউ লেগেছে শিক্ষাঙ্গনে। এবারে কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিষয়টি ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত করা যাবে। ইনোভেটিভ টেকনিক পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। আসলে উপযুক্ত জনশক্তি গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।
পাঠ-পঠনের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের সুযোগ-সুবিধা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অতি সহজে পাওয়া যাচ্ছে। এর সুফল গ্রহণ করার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মান উন্নীতকরণ আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বিস্তৃত করার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতা নির্ভর একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি ২০১০ সালে জাতিকে শেখ হাসিনা উপহার দিয়েছিলেন। তবে গত পাঁচ বছরে এটি বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এর মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দের অপ্রতুলতা। শিক্ষা নীতিটি যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় সেজন্য এখন থেকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে এটি বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। শিক্ষা হবে সর্বজনীন। এখানে কোন বিভাজন থাকবে না। শিক্ষকরা নিজ দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করবেন এবং জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করা উচিত।
শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি যে, শিক্ষার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়। যদি শিক্ষিত মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা যায় তবে তা দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে আরও বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আসলে শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপযুক্ততা ও মানসিকতাও থাকতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মান আশানুরূপ নয়। এই মান উন্নত করতে হবে। আউটকাম বেইজ লার্নিং টেকনিকের সুষ্ঠু প্রয়োগ করা উচিত। তবে এটাও ঠিক যে, টপ ৩০০ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১২৬ এবং বুয়েটের অবস্থান হচ্ছে ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে। এ দুরবস্থা কাম্য।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসন অক্ষুণ্ন রেখে অভিভাবকদের হয়রানি রোধ করতে পরীক্ষার প্রশ্ন স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় যেন অনুগ্রহপূর্বক ইন্টারমিডিয়েটের সিলেবাস অনুযায়ী করেন। তারা যেন আনসিন প্রশ্ন না করেন সেজন্য বিশেষ অনুরোধ থাকবে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের কাছে। ভর্তি পরীক্ষা কমিটি অবশ্যই এ বিষয়ে দেখভাল করবে। আবার কোনরকম গিনিপিগ ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের বানানো চলবে না।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের নৈতিকতা,আন্তরিকতা, জ্ঞান বৃদ্ধির প্রয়াস অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নেই আইন অনুযায়ী সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আপোস থাকবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)