স্কুলের শিক্ষকদের লাঞ্জিত করার ঘটনা যেন বাংলাদেশের সমাজচিত্রের অংশ হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যদের দ্বারা। সারাদেশে স্কুল পরিচালনা কমিটি নিয়ে এর আগেও অনেক সমালোচনা-বিতর্ক হয়েছে। সরকার এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন আইন না করলেও স্কুল পরিচালনা পর্ষদের ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা আছে, নির্দেশ দিয়েছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। কিন্তু সে নির্দেশ কেউ মানছে বলে মনে হয় না। গত কয়েকবছর শিক্ষক লাঞ্ঝনার ঘটনা বেড়েছে। নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম অবমাননার নামে জঘন্যভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্য লাঞ্ঝনা করলে তা দেশব্যাপী অালোড়ন তোলে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সঙ্গে অবমাননাকর আচরণ করেন ওই স্কুলের পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য। ঘটনার বিচারের দাবিতে সড়ক অবরোধ ও ক্লাস বর্জন করে শিক্ষার্থীরা। ঘটনার বিবরণীতে জানা যায়, তেজগাঁও শিল্প এলাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ শরীফকে ১৬ জানুয়ারি স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মোহাম্মদ ইসহাক সপ্তম শ্রেণির (ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) ক্লাস চলার সময় এক শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য তদবির করেন। শিক্ষক অস্বীকৃতি জানালে শিক্ষার্থীদের সামনেই তাকে লাঞ্ছিত করেন ওই সদস্য। ঘটনার বিচার না হওয়ায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে। এক পর্যায়ে মূল সড়ক অবরোধও করে শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় মনে হয়, স্কুল পরিচালনা পর্ষদের একেকজন সদস্য যেন মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। স্কুলের ক্লাস চলার সময় একজন শিক্ষককে অন্যায় আবদার করবেন, আবার সে আবদার না রাখলে ওই শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে অপমান করবেন, এটা যেন খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু, এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। যে বালক-বালিকারা শিক্ষকদের কাছ থেকে নৈতিকতা শিক্ষা নেয়, তাদের সামনে তাদের গুরুকে লাঞ্ছনা করা কত বড় অমানবিক এবং বর্বর কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে মানুষের শিক্ষার প্রথম বুনিয়াদ। এই সময় শিশুরা যা দেখবে, যা শিখবে তা তাদের মননে গেঁথে থাকবে। শিক্ষকের অপমান কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, আর শিক্ষার্থীদের সামনে তাদের শিক্ষককে অপমান আরো ন্যাক্কারজনক। স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কোন নির্দিষ্ট আইন নেই বলে এলাকার প্রভাবশালী যে কেউ এই কমিটির সদস্য হতে পারেন। দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা এইসব কমিটির সভাপতি/সদস্য হয়ে থাকেন। তারা নিজেদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একেকজন হোমড়া চোমড়া হয়ে বসেন এবং স্কুলকে ব্যাবহার করেন। যেখানে আদৌ তাদের কাজের এখতিয়ার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সারাদেশের স্কুলগুলোতে এইসব কমিটির ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নতুবা শিক্ষা ব্যবস্থার এহেন দুর্দশা সহজে যাবে না। অবিলম্বে আমরা তেজগাঁও স্কুলের শিক্ষক লাঞ্ঝনার ঘটনারও বিচার চাই। আমরা একথাও বলতে চাই, সড়কে নেমে এসে শিক্ষার্থীরা হয়তো ঠিক কাজ করেনি, কিন্তু প্রতিবাদী হয়ে শিশু শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত কাজটিই করেছে।