বিখ্যাত লেখিকা টনি মরিসনের বিখ্যাত বই ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’র নায়িকা পিকোলাকে স্মরণ করে শুরু করছি, যিনি তার সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ চাহিদাস্বরুপ নীলতর চোখের অধিকারিণী হতে চেয়েছিলেন। কারণ, সমাজই তার সৌন্দর্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছিল, যেখানে একজন আফ্রিকান কালো নারী সমাজ কর্তৃক সৌন্দর্যের মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য। পিকোলা তাই নীলতর চোখের অধিকারী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আর তারই ফলশ্রুতিতে, সেই নীল চোখ পেতে তিনি তার নিজ সমাজ দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিলেন বিভিন্নভাবে। যুগে যুগে সমাজ কর্তৃক সৌন্দর্যের মাত্রার এবং নারীর পোশাকের শুদ্ধতার বিনির্মাণ তাই প্রকারন্তরে একধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। নারীকে কোন পোশাকে রমণীয় লাগবে অথবা আবেদনময়ী লাগবে সেই নির্মাণও বোধকরি সমাজের স্টেরিওটিপিকাল কিছু ভাবনার সমষ্টি।
এবারে আসি মূল আলোচনায়, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি মেয়েদের চিরাচরিত পোশাক শাড়ি নিয়ে লিখতে গিয়ে সৌন্দর্যের মানদণ্ডের যে বিনির্মাণ করেছেন এবং বর্ণনায় ও অভিব্যক্তিতে নারীর সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে আমার জিজ্ঞেস্যগুলো তুলে ধরছি- কালে কালে, যুগে যুগে নারীকে শৃঙ্খলিত করতে যে সব কৌশল সমাজ দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে পোশাক তার মধ্যে অন্যতম একটি। প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক ও সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাঙালি নারীর সৌন্দর্য যে শাড়িতে প্রকাশিত হয় এবং পোশাক হিসেবে এই শাড়ির আবেদনময়তা ও গ্রহণযোগত্যা যে বাঙালি সমাজে স্বীকৃত তা নিয়ে আমার দ্বিমত নেই। আর, আমরা বহুকাল ধরেই আমাদের মা, নানী তথা নারীকূলকে এই শাড়িই পরিহিত অবস্হায় দেখে আসছি। তাই, শাড়ি পরার এই রীতি বা প্রথা প্রকৃতপক্ষে আমাদের মজ্জাগত এবং বাঙালি নারীর আদর্শ পোশাক হিসেবেও হয়ত বিবেচিত। আমাদের বাঙালি নারীরা যদি চিরাচরিতভাবে অন্যকোন পোশাক পরতেন, আমরা হয়ত সেভাবেই নারীকে আবিষ্কার করতাম। অধ্যাপক স্যারের লেখায় যে বিষয়গুলো একজন নারী হিসেবে আমার কাছে অবান্তর লেগেছে তা নীচে তুলে ধরছি:
প্রথমত, তিনি তার লেখাটিতে আবহমান বাংলার লেখকদের বরাত দিয়ে শাড়িতে বাঙালি নারীকে যে যৌন আবেদনময়ী লাগে, আবার একই সাথে শালীনও লাগে তা দেখিয়েছেন! আমার প্রশ্ন হলো, তাহলে একই শাড়িতে নারীকে শালীন আর যৌন আবেদনময়ী দু’রকমই লাগে? এরকম চরম বৈপরীত্যপূর্ণ বক্তব্য দ্বারা এই সমাজের শোভিনিস্ট পুরুষদের মনের গহীনে লালন করা পুরুষতন্ত্রের আদিম রূপটিই ফুটিয়ে তুলেছেন। এ যেন, শ্যাম্পুর সেই বিজ্ঞাপনটির মতোই, যা খুশকিও দুর করে আবার কন্ডিশনারও যুক্ত। কারণ, পোশাক হিসেবে শাড়িকে নয়, শাড়ি পরার মাধ্যমে নারীর শরীরের উচুঁ-নীচু ভাজের সুলুক সন্ধানই আপনার লেখার মূল উপজীব্য বলেই অন্তত আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, তিনি তার লেখার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে বলেছেন, “সব দেশের মেয়েদের শাড়িতে এমন অপরূপ লাগবে না। পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকার নারী শরীরেই কেবল শাড়িতে এ অলীক রূপ ফুটে ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রিয়দর্শিনী সুকুমারী তন্বীদের দেহবল্লরীতে—সে বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতের-যেখানকারই হোক। বিশালদেহী আফ্রিকার নারীর জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ নারীর উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না।”
সত্যিই কি তাই? আমার ধারণা বিপরীত। কারণ, প্রাচ্যের নারীদের আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরং কর্মবান্ধব পোশাকে দেখতেই অভ্যস্ত। তদুপরি, শাড়ি পরিহিতা লম্বা তরুণীটির শরীরের ভাজের যে পাট আপনি খুঁজেছেন এবং শাড়ি পরতে গেলে ‘শারীরিকভাবে নমনীয়’ হলে তা ‘মধুর’ হয় বলে যে মত প্রকাশ করেছেন, তা নারীর পোশাক নয়। বরং লম্বা, নমনীয় বা তুলতুলে নারী শরীরকেই যে অধিকতর আবেদনময়ী লাগে, সেটাই প্রকাশ করতে চেয়েছেন বারং বার। এ যেন এক ধরণের যৌন সুরসুরিমূলক ভাবনার শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ।
সম্মানের সঙ্গে অধ্যাপক সায়ীদকে বলতে চাই, বাঙালি মেয়েরা তাদের শাড়ির মধ্যে তাদের অস্তিত্বকেই খুঁজে বেড়ায়। শাড়ি একইসাথে তার সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ধারক বাহক। আর একারণেই তারা শাড়ি পরেন, নিজের শরীরের ভাঁজগুলো প্রকাশ করার বাসনা থেকে নয়।
তিনি একজন ‘আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর’ দাবিদার হয়ে যখন নারী সৌন্দর্যের গড়পড়তা সেই ৩৬/২৪/৩৬ এর মতন করেই লম্বা অথবা খাটো নারীদের উচ্চতা বা খর্বাকৃতি নিয়ে সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করতে চান, তখন আমার মতোই অধিকাংশ বাঙালি নারীর কাছে তা নেহায়েত হাস্যকর ঠেকে বৈকি। দৈহিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে ছেলেদের সৌন্দর্য বড় ব্যাপার নয় বলে আপনি যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তা তার স্টেরিও টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই উন্মোচিত করেছে।
আবার, একইসাথে লম্বা নারীদের শাড়ি পরলে ‘শাড়িজনিত গীতিময়তা’ ফুটে ওঠে টাইপের কথায় তিনি প্রকারন্তরে পুরো নারী জাতিকেই অসম্মান করেছেন। সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের ভাবনা পাশ্চাত্যের সৌন্দর্যকেন্দ্রীক ধারণারই প্রতিচ্ছবি। যেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে অসুন্দর রূপে গণ্য করা হয় এবং এই ধরনের ভাবনার বিরুদ্ধে লিখেছেন নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট লেখিকা সদ্যপ্রয়াত টনি মরিসন তার বিখ্যাত ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ উপন্যাসে। তাই, নারী শরীরের পণ্যায়ণ কিংবা শারীরিক সৌন্দর্যের সামাজিক বিনির্মাণ অথবা শাড়িতে কোমল শরীরের আবেদনময়ীতা কোথাও কোথাও যেন একইসুরে প্রোথিত বলেই মনে হয়।
তৃতীয়ত, তিনি ‘শারীরিক লস ঢাকার কৌশল’ এর নামে মানুষ হিসাবে মানুষকেই ছোটো করেছেন। আর হাস্যকরভাবে সেক্ষেত্রেও আবার সেই শাড়িকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাঙালি নারী তার শারীরিক খুত ঢাকার জন্য শাড়ি দিয়ে যেভাবে মাথা/কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত আবৃত করে রাখতে পারে শুধুমাত্র দীর্ঘাঙ্গী সৌন্দর্যময়ী দেখাতে পারে বলে বা তার খুঁত ঢাকার কৌশল হতে পারে বলে-তা নিতান্তই অত্যন্ত সস্তামানের ভাবনা বলে মনে করি। বাঙালি নারীর শাড়ি তার ঐতিহ্য, ভালোবাসা এবং চিরায়ত বাঙালিত্ব প্রকাশেরও মাধ্যম। নিজেকে আবেদনময়ী হিসেবে প্রকাশের কোন ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি নয়।
চতুর্থত, আধুনিক নারী যেমন শাড়িতে স্নিগ্ধ, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী পোশাক পরতে হয় প্রতিনিয়তই। যেমন একজন নারী সৈনিক, পুলিশ, সাংবাদিক, পরিব্রাজক, বৈমানিক যখন কর্মক্ষেত্রে বের হন, তখন তিনি সালোয়ার কামিজ বা প্যান্ট শার্টে যতটা করিৎকর্মা, শাড়িতে যে ততটা নন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা তা প্রতিনিয়ত অনুধাবন করেন।
পরিশেষে, শাড়ির গুণকীর্তণ করতে গিয়ে যখন নারীর শরীরের উঁচু-নিঁচু ঢেউয়ের সন্ধান করেন অথবা ‘সৌন্দর্যের লালসার’ এক মাত্রা হিসাবে অবহিত করেন, তখন এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মনে হয়, শাড়ি পরিহিতা রমণীরা এখনও পুরুষদের লালসার বাইরে যেতে পারে কি? কারণ, তার লেখায় শাড়ি নয়, বরং শাড়ির পরিহিতা নারীর শরীরের পাঠ উদ্ধারের চেষ্টা করে গেছেন পুরো লেখাটিজুড়ে। শুধু তাই নয়, তিনি কীভাবে অতি সরলীকরণ করলেন যে, বাঙালি নারীরা শাড়ি নামক পোশাকটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছে? কারণ এখনো বাঙালি নারীরা ঐতিহ্য পরম্পরায় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় অনুষ্ঠানে দল বেঁধে শাড়ি পরে , খোঁপায় ফুল গুঁজে ঘুরতে বের হয়। তিনি কি পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি বা অন্যান্য জাতীয় দিবসগুলোতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের কথা বিস্মৃত হয়েছেন? প্রকৃতপক্ষে শাড়িতে বাঙালি নারী অনন্য তার শারীরিক বিনির্মাণের জন্য নয়, তার চিরায়ত সৌন্দর্যের জন্যই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)