‘শাড়ি’ শিরোনামে গত ২৯মে অগাস্ট প্রথম আলোতে একটি নিবন্ধ লিখেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। লেখাটি প্রকাশের পর তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। কারণ অনেকেই মনে করছেন, শাড়ি বিষয়ে অধ্যাপক সায়ীদের লেখাটি অত্যন্ত ধর্ষকামী, বর্ণবাদী ও লিঙ্গবৈষম্যমূলক। লেখাটিতে নারীকে কেবলই যৌনবস্তু এবং পুরুষের দেখার আরাম ও আনন্দের সামগ্রী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
আমি নিজেও মনে করি, পরুষতান্ত্রীক মূল্যবোধের গৎবাঁধা ছাঁচে উপস্থাপন করে নারীকে তার শরীরের আকার, আকৃতি ও সৌন্দর্যের ধারণার মধ্যে বন্দী করে রাখার দৃষ্টিভঙ্গি দোষে অধ্যাপক সায়ীদের লেখাটি দুষ্ট।
সাংবাদিকতার সাথে যারা জড়িত তারা জানেন যে, ব্যক্তির সুনাম যত বড় হয়, তার সংবাদও তত বড় হয়। ফলে, ট্রাম্প বা মোদী বা এন্জেলিনা জোলিকে মশা কামড় দিলেও সেটি বড় সংবাদ। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যদু মধু রাম শ্যাম নন। তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান এবং বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারী ব্যক্তি। তিনি একজন ওপিনিয়ন লিডার বা মতমোড়ল। তার কথা ও কাজ বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে কোনো ধারণা গ্রহণে বা বর্জনে বা কোনো কিছু সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারনায় প্রভাবিত করতে শক্তিশালী প্রভাব রাখে। তাই, এমন একজন মানুষ যখন ধর্ষকামী, বর্ণবাদী, লিঙ্গবৈষম্যমূলক ধারণাকে স্বতঃসিদ্ধ সত্যের ঢং-এ উপস্থাপন করেন তখন সমাজের গণমানসে সেটির সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়।
অধ্যাপক সায়ীদের এই রক্ষণশীল ও কট্টর লেখার জন্য আমি তার সমালোচনা করি। কিন্তু যারা বলছেন বা মনে করছেন যে, এই লেখার কারণে অধ্যাপক সায়ীদকে অবশ্যই নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইতে হবে আমি তাদের সাথেও একমত নই। কারণ বলপূর্বক মাফ চাওয়া-চাওয়ি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের বদলে জোর খাটানোর উদাহরণই তৈরি করে মাত্র।
মাফ চাওয়া প্রসঙ্গেই মনে আসছে কয়েক বছর আগে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের মাফ চাওয়ার একটি ঘটনা। প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি কার্টুনকে কেন্দ্র করে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে বায়তুল মোকাররমে গিয়ে সম্পাদক হিসেবে মতিউর রহমান মাফ চেয়েছিলেন। আজ যদি অধ্যাপক সায়ীদকে সামাজিক চাপে ফেলে জবরদস্তিমূলক ‘দুঃখিত ও মাফ চাই’ মর্মে একটি বক্তব্য আদায় করা হয় তাহলে এটির সাথে মৌলবাদীদের চাপের কোনো চরিত্রগত ফারাক থাকবে বলে মনে হয় না।
মাফ চাওয়া বা দুঃখিত বোধ করার অন্তর্নিহিত দর্শন হলো, কৃতকর্মের জন্য ভেতর থেকে ব্যক্তির অনুভূতি বা বোধের পরিবর্তন আসা। অর্থাৎ তার রিয়েলাইজেশান বা অনুধাবনে বদল আসা। যদি অনুধাবনে কোনো বদলই না আসে, তার লেখা কোন দোষে দুষ্টু অধ্যাপক সায়ীদ যদি সেটি হৃদয়ঙ্গম করতে না পারেন তাহলে এই ক্ষমা চাওয়ার অর্থ কী?
ইসলাম ধর্মে যে তওবা’র কথা বলা হয়েছে, যতখানি বুঝতে পেরেছি তওবা’র মূল দর্শনও তাই। তওবা পড়ে আবার সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি করা এবং পুনরায় তওবা করে ‘গুনাহ মাফ করানো’ বা দায় থেকে মুক্তি লাভ করা বোধ হয় তওবা’র দর্শন নয়। তওবার দর্শন হচ্ছে, ব্যক্তির কৃতকর্মটি যে সঠিক ছিল না সেটি অনুধাবন করা এবং আত্মশুদ্ধি ঘটানোর স্বার্থে সেরকম আর না করার প্রতিজ্ঞা করা। এই প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদা ব্যক্তি করে তার নিজেরই সাথে।
কারাগার তৈরির পেছনেও শুদ্ধির দর্শনটা ছিল। দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিকে তার কৃতকর্মের জন্য শুধু দেহ ও মনে শাস্তি প্রদান নয় বরং তার চিন্তার পরিশোধন ঘটানোও ছিল কারাগারের উদ্দেশ্য। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা শুনতে পাই, কারাগারে গিয়ে ছোটো অপরাধী আরো বড় অপরাধী হিসেবে সিদ্ধ হস্ত হয়ে ওঠে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়েও এমন কাহিনীর উদাহরণ আছে।
তাই, অধ্যাপক সায়ীদকে ক্ষমা চাইতে বলার পক্ষে আমি নেই। আমি বরং বলবো, তার নিকট বন্ধুদের মধ্যে যদি এমন কেউ থেকে থাকেন যিনি মনে করেন অধ্যাপক সায়ীদের এই লেখাটি একটি সেক্সিট, রেসিস্ট, স্টেরিওটাইপ, ভয়ারিস্টিক, প্যাট্রিয়ার্কিক লেখা, তিনি যেনো তার সেই মতের যুক্তিটা অধ্যাপক সায়ীদকে এক বিকেলে চা খেতে-খেতে আন্তরিক পরিবেশে বুঝিয়ে বলেন। যেনো তাকে বুঝিয়ে বলেন, সমাজে অধ্যাপক সায়ীদের কথার একটা প্রভাব আছে। তাই, যদু মধু রাম শ্যামের কথায় প্রতিক্রিয়া না হলেও অধ্যাপক সায়ীদের কথায় প্রতিক্রিয়া হয়।
পাশাপাশি, এটিও মনে রাখতে হবে যে, সকল মানুষেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমান। অধ্যাপক সায়ীদ শাড়ি নিয়ে নারী প্রসঙ্গে তার মত প্রকাশ করেছেন। প্রকাশিত সেই মতের ভেতরে উঠে এসেছে, নারী নিয়ে সমাজে প্রচলিত অনেক ক্ষতিকর ধারণার সারৎসার। কিন্তু এখন প্রশ্ন করা দরকার যে, সমাজে উদার ও আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলনের একজন প্রবক্তার চিন্তা ও মনোজগত নারী প্রশ্নে যদি এতোটা কট্টর হয় তাহলে সাধারণ মানুষের ভাবনা আরো কতটা কট্টর হতে পারে?
জোর-জবরদস্তি দিয়ে সাধারণত সমাজে বদল আসে না। বদলের জন্য চাই ভেতর থেকে পরিবর্তন। চাই সামাজিক সাংস্কৃতিক বদল। প্রচলিত ন্যারেটিভ বা মনোভঙ্গি, ব্যাখ্যা ও ধ্যান-ধারণা পাল্টাতে হলে চাই কাউন্টার-ন্যারেটিভ। সেই বদল একদিনে হবে না। এক-দুইজন এই বদল আনতে পারবে না। এই বদলের জন্য চাই নারী-পুরুষের চিন্তার বৃহত্তর ঐক্য। এই বদলের জন্য চাই অগুনিত মানুষের অংশ গ্রহণ। যে যার জায়গা থেকে কাজ করে যাবে। এইসব কাজের ফসল বিন্দু বিন্দু বালু-কণার মতন জমতে-জমতে একদিন হবে প্রার্থিত সিন্ধু রচনা; আসবে কাঙ্ক্ষিত বদল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)