সর্বগ্রাসী দলীয়করণের রাজনীতির দেশে কিছুটা স্বচ্ছতা অার স্পষ্টতা নিয়ে জনগণের ভরসার শেষ অকুস্থল দেশের বিচার বিভাগ। অাসলে রাজনীতি অার শাসকদের হয়ে উঠবার কথা ছিল দেশের জনগণের অাশা ভরসার অাশ্রয়ের ঠিকানা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনীতি জনগণের মনে অাস্থার জায়গাটুকু অর্জন করতে পারেনি স্বাধীনতাত্তোর কোন অামলেই। ত্যক্ত-বিরক্ত অার নিপীড়িত মানুষের বিচার পাবার শেষ অাশ্রয় হিসেবে অাছে উচ্চ অাদালত।
স্বীকার করতেই হবে দেশে সরকারগুলো উচ্চ অাদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অতীতে অনেক রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে। এমন নজির কিন্তু একটি দুটি নয়। ব্যত্যয় যে নেই বিচার বিভাগের সেটি নয় কিন্তু। স্বীকার করতেই হবে বিচারকরা তো ভিনগ্রহ থেকে অাসা এলিয়েন নন। তারা এই সিংহভাগ নীতিহীন-রাজনীতি-সর্বস্ব দেশেই বাস করেন। এখানে কৃষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক সবাইকে ন্যায্য পাওনাটুকু পেতেও দলের জার্সি গায়ে চড়িয়ে রীতিমত স্টাইকার হয়ে অানুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এমন দলবাজি সর্বস্বতা অাজ বাংলাদেশের বাস্তবতা।
এমন বাস্তবতায়ও কিছু সীমা-ও-স্বার্থবদ্ধতা সত্বেও বিচার বিভাগই গড়ে উঠেছিল ন্যায় ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। প্রথা ভাঙ্গা বা অানুগত্য তত্ত্বের উদাহরণীয় বিচারক বিচারপতি খায়রুল হকের কথা অালোচনা না করাই ভাল। সিইসি অাব্দুল অাজিজের মতো লজ্জাহীন চরিত্রকে বাংলাদেশ ভুলে যেতে চাইলেও পারবে না। তিনিও একজন বিচারপতি ছিলেন।
উচ্চ আদালতের কোন বিচারকের অবসর গ্রহণের পর পুনরায় কোন লাভজনক সরকারি চাকরি বা পদে তার নিয়োগকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। গণপরিষদ বিতর্কে চাকরিকালীন বিচারকদের নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য এটি প্রয়োজন বলে অভিমত দেওয়া হয়। খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকার সময় তারই নির্দেশক্রমে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে বিচারকদের অবসর গ্রহণ করার পর প্রজাতন্ত্রের সব ধরনের কর্মে নিয়োগকে অবৈধ করা হয়। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট উল্লেখ তার রায়ে ছিল না।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির সমান মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে তার নিয়োগ গ্রহণ স্ববিরোধিতামূলক এবং তার প্রদত্ত রায়ের সাথে সাংঘর্ষিকও। বিচারপতি খায়রুল হকের মতো শাসক অনুকূল বিচারক যে বিচার বিভাগে অার নেই, বাস্তবতা তা অামাদের বিশ্বাস করতে বাধা দেয়। অাদৌ দেয় না।
বাস্তবতা দেখায়, জিয়াউর রহমানের জারি করা সবচেয়ে বেশি সামরিক ফরমান এখনো বিচার বিভাগে প্রাবল্যে বিদ্যমান। এখনো বাংলা অাইনি পরিভাষা তৈরী না করতে পারার অজুহাতে অাদালত ইংরেজি রায় দেন। সঙ্গত কারণেই সুবিধান্বেষীদের নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পথ রয়ে যায়। গত এক সপ্তাহে অামরা তাই দেখছি। তবু অামাদের স্বীকার করতেই হবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অপরিবর্তনীয় অনড়তম মৌলিক কাঠামো। অামাদের ভ্রষ্ট রাজনীতি সংবিধানের কোনে একটি অনুচ্ছেদকে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করে শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধাবাজির তাড়নায়। অথচ বাক স্বাধীনতা ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিরর্থক।
দুই.
অামি অাইনের মানুষ নই। অাইন বিষয়ে অামার পড়াশোনাও খুব সীমিত। অামার মরহুম অাইনজীবী পিতা অামাকে অাইনের শাসনে শ্রদ্ধাশীল হতে তাড়িয়েছেন অাজীবন। গত দুদিনে সংবিধান নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। কথা বলেছি বৃহত্তর সিলেটের বর্ষীয়ান রাজনীতিক দেশের অন্যতম প্রবীন অাইনজীবী চারবারের সাংসদ সাবেক মন্ত্রী এডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরীর সাথেও।
২০১৭ অার ১৯৭২ সাল যেমন এক নয় তেমনি বাস্তবতাও পাল্টেছে বহুুদুর। সময়ের সাথে বিচারকের রায়ে পর্যবেক্ষণের ব্যাপ্তি প্রশাসনের প্রয়োজন বাড়ে। এখন কোন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রায় গেলেই তারা সেই বিচারপতিকে অপসারণ করতে চাইতে পারেন কি? এমনকি বিচারকরাও কোন এমপির বিরুদ্ধে রায় দিতে চিন্তা করবেন? এটাই কি কাম্য হওয়া উচিত? অাপাতঃ দৃষ্টে বাংলাদেশের গত কদিনের বাস্তবতা সে অনায্যতার কথা বলছে। রায়ে বা পর্যবেক্ষনে কোথাও বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা বা সে চেষ্টাও হয়নি। তোতা পাখির শ্লোগান সর্বস্ব বিরোধিতা করছেন কজন, রায়টি অাদৌ কত পৃষ্ঠা পড়েছেন সে নিয়ে ঢের সন্দেহ অাছে। সমাজ, রাজনীতির গুণগত নৈতিক অধঃপতনের কথা সবাই বলছি অামরা। কেন বিচার বিভাগ তাদের পর্যবেক্ষণে সে বাস্তবতার কথা বলতে পারবেন না?
ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে কারো। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সর্বোচ্চ অাদালতের সাত জন বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে এ রায় দিয়েছেন। এটি বিভক্ত কোন রায় নয়। তাহলে শুধু প্রধান বিচারপতি কেন টার্গেট? এই প্রধান বিচারপতি যিনি অপু উকিলের ভাষায় ‘হিন্দু নন’ যেমন অাজ, গতকাল ছিলেন ভস্ম জাতীয়তাবাদীদের ‘মালাউন’। অামরা সত্যি বড্ড ভুলোমনা জাতি। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনেও এস কে সিনহার কমলগঞ্জের বাড়ীতে নাশকতা চালিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। সেদিন তো অাওয়ামী লীগ দলীয় সাংবাদিকেরাও এস কে সিনহার তথাকথিত দুর্নীতির ‘গল্প’গুলো লেখেননি ফেসবুকে।
এভাবে ভিন্নমতের নামে যেভাবে সর্বোচ্চ অাদালতের প্রধান বিচারপতিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে, হেয় অপমানিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা কি সভ্য গণতান্ত্রিক কোন রাষ্ট্রে ঘটে? কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ হয় বলে অামার জানা নেই।
দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন এক সাক্ষাতকারে বলেছেন,”সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদই হচ্ছে আমাদের রক্ষাকবচ, গাইডলাইন। এতে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবলই সংবিধানের অধীন এবং কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এরপরও কেন আমরা বিতর্ক করছি বুঝতে পারি না। “
আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদের মতো সিনিওর মন্ত্রীরা কি ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আদালতের রায়টা পুরো পড়েছেন? অহেতুক যুক্তিহীন তর্কহীনভাবে বুলি অার গালি ছুড়ঁছেন। যা রাজনীতি এবং বিচার ব্যবস্থার সুস্থ্ সময়ে বিরল।
অনেকের বক্তৃতা শুনলে মনে হয় তারা আসলে রায়টা পড়েননি। দলের তৃতীয় শ্রেণীর সমর্থকদের মত বক্তৃতা করছেন। অাসল কথা হলো ৫ জানুয়ারির প্রশ্নসাপেক্ষ এ সরকার ক্ষমতায়,সে কারণে তাদের অাঘাত একটু বেশি লাগে।
আইনমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, “এটা কিন্তু ৭৯৯ পাতার একটা রায়। রিভিউ করতে গেলেও পড়ে জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সেটা সময়সাপেক্ষ। আজ-কাল-পরশুর মধ্যে হয়ে যাবে- সেটা আমি বলব না।“ তা হলে তিনিই কি করে পুরো বিষয়টি না পড়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুললেন? এতো অাইনের হাত ধরেই যেন বেঅাইনি।
অবশ্য, বিচারহীনতা, সাম্যহীনতা অাজ সমাজ অার রাষ্ট্রের নিঃশ্বাসে,ধমনীতে। ইনসাফ যেন ভুগছে ক্যান্সারে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ছিল এ তিনটি। অন্যায় কী যে বিশালতায় অাসীন দেশময়!
বিচার মানি কিন্তু তালগাছ বিচারক সব অামার, এ অসুস্থ ধারা থেকে রাজনৈতিক শাসকশ্রেণী বেরিয়ে না এলে ছন্দপতন তখন কেবল অনিবার্যতার পরিনণতি পায়।
তিন.
এবার কয়েকটা বিচ্ছিন্ন একইসাথে অপ্রাসঙ্গিক বাস্তবতার কথা বলি। ভারত বা চীন তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেদের দেশের স্বার্থ দেখে। সেখানে কোন সরকার বা কে ক্ষমতায় সেটা বিষয় নয়। ব্যাপারটি সুবিধার, লেনাদেনের। সে কারণে ‘পুতুলেরা’ একলাই খেলুক তা চান না মোড়লেরা। তারা ‘বি’ টিমটিকেও মাঝে মধ্যে হাতে নেয়! অবশ্য তা অাপন খেলারই স্বার্থে।
রাজনীতিও কিন্তু অাধুনিক পরিভাষায় কূটচালে নৈপুণ্যের খেলা। ভারত যখন অনেকগুলো বাংলাদেশমুখী নদীর স্লুইস গেট খুলে দেয়, বাংলাদেশে তখন উচ্চ অাদালতের প্রধান বিচারপতিকে রাজনৈতিক শাসকশ্রেণী সংখ্যালঘু বানাচ্ছে, ভারতীয় একাধিক দৈনিক রীতি ভেঙ্গে সিন্ডিকেটের মতো শিরোনাম করছে: “এস কে সিনহা হচ্ছেন বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি…”। অার বিএনপিও তখন ভারতের বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে লন্ডন থেকে।
অাশার কথা হলো: সরকার পরিস্থিতি বুঝতে পারছে। সে কারণে প্রতিদিন অাধ ডজন মন্ত্রী,অর্ধমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যেমন কথা বলছেন, তেমনি অাওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকও এস কে সিনহার বাড়ী ছুটছেন। বাইরে চাপ দিয়ে ভেতরে সমঝোতা বোধকরি চানক্য শিখিয়ে গেছেন।
কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, আমাদের সব শঙ্কা মিথ্যে হোক। হেলাখেলার ময়দানে অাগুনের খেলা মাঠ যেন না পোড়ায়। সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ না করুক উচ্চ অাদালত। যেকোন অগণতান্ত্রিকতার অশুভ ছায়াচিহ্ন মুছে যাক বাংলাদেশের অাকাশ হতে।
তবে, সেটি ফলাফল পূর্বনির্ধারিত কোন খেলা হলে সে অাত্মঘাতি মরণখেলা ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে বাংলাদেশের জন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)