২ অক্টোবর স্নান ও প্রাতরাশ সেরে থিম্পুর সম্ভাব হোটেলকে বিদায় জানিয়ে, পুনাখা ও ওয়াংডু শহরের পাস হাতে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম পুনাখার পথে। এতক্ষণ একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি, আমাদের বাংলাদেশের সময়ের সঙ্গে ভুটানের ব্যাবধান মাত্র সাত মিনিটের। গাড়ি এগিয়ে চলছে। পাহাড়-নদীর ওপরে লম্বা লম্বা গাছের থেকে ঝুলছে সার সার রঙিন ধ্বজা বা পতাকা যার ওপরে পালি স্ক্রিপ্টে লেখা তিব্বতীদের ধর্মের বাণী। আকাশে, বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই সব ধর্মের অমোঘ কথা, শান্তির বাণী, আদর্শের কথা, অহিংসার কথা, নদীর জল, বাতাস সেই বাণীর ধারক ও বাহক, এই তাদের বিশ্বাস ! পুরা ভুটানেই আমরা এই চিত্র দেখলাম।
উজ্জ্বল দিন, ঝকঝকে আকাশ, সবুজ পাহাড় আর সাইপ্রেস এবং আপেলের বাগানের ভেতর দিয়ে ছুটছে গাড়ি। পাহাড় আর বন রাস্তা ছেড়ে একটু দূরে আত্মগত, স্থির। পাহাড়ি পথে যেতে যেতে কেবলই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে ভুটানি নারীদের ফলের পসরা সাজিয়ে রাখার দৃশ্য। পথের পাশে বিভিন্ন জনপদে বার-কাম-রেস্তোরাঁও আছে। এই জিনিসটা প্রায় সর্বত্র। অবশ্য রাস্তায় মাতাল চোখে পড়েনি। আমাদের গাড়িচালক তাশিকিজি জানালেন, এখানে প্রকাশ্যে মাতলামি করলে শাস্তি হিসেবে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে কিছুদিন আটক থাকতে হবে। ধূমপান নিয়েও এদেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা । প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখিনি কাউকে। তবে লুকিয়েচুরিয়ে চলে। প্রকাশ্য ধূমপানের শাস্তি পাঁচশ টাকা জরিমানা। জেলের বিধানও নাকি আছে।
আমরা এগারটার দিক দোচালা পাস পৌঁছলাম। অনেক দেশের অনেক পর্যটকদের দেখা মেলে ওখানে। মেঘের ভেতর নেমে পড়ি আমরা। আমাদের চারপাশে মেঘ আর বাকি সব অস্পষ্ট। খুব আস্তে আস্তে মেঘ সরতে থাকে। দ্রুক ওয়াংগাল সোরটিন আমাদের সামনে। ২০০৩ সালে এটা তৈরি হয়। বছরে অন্তত একবার রাজা এখানে ঘুরতে আসেন। মন্দিরের ভেতর ও বাইরের দেওয়াল জুড়ে বৌদ্ধ দেবতাদের ঐতিহাসিক কাহিনি ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করা।
৯০০০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রিতে দেখা যায় নীল পাহাড় আর সবুজ বন। কোনো পাহাড়শীর্ষ কুয়াশার অস্বচ্ছ ওড়না মাথায় জড়িয়েছে। আবার কোনো চুড়োর মাথা যেন খেলার ছলে ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঘ। কোথাও পাহাড় দাঁড়িয়ে দূরে মেঘমাখা হয়ে। প্রায় ১৫ বছর আগে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফা গোষ্ঠীর সঙ্গে ভুটানিদের সেখানে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তৈরি হয়েছে দোচালা। পাহাড়ের ওপরে এখানেও নির্মিত হয়েছে কারুকার্যখচিত বৌদ্ধমন্দির। পাশের পাহাড়ে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে সুতায় ছোট ছোট চৌকোনা করে কাটা কাপড়গুলো বেঁধে গাছ থেকে গাছে টানিয়ে দেওয়া। দোচালা পাস থেকে সহজেই বরফে ঢাকা হিমালয় চোখে পড়ে।
সূর্যের আলো পড়লে হিমালয়ের সোনালি রঙ ধারণ করে। সেই জ্যোতি দোচালাতেও ঝিলিক দেয়। আমরা এই অপরূপ দৃশ্য এক নজর দেখেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় সেই দৃশ্য। প্রবল কুয়াশা আর বৃষ্টির জন্য দোচালা ক্যাফের উপর থেকে ভালোভাবে হিমালয় দর্শন করতে না পারার কিঞ্চিত দুঃখ নিয়ে কেবল কফির স্বাদেই আমাদের তৃপ্ত থাকতে হয়েছে। পথে একটি হোটেলে খাওয়া দাওয়া। দুপুরের খিদে বলে কথা। চাওমিন, ফ্রাইডরাইস, সবজি, ছোট ছোট পাকুড়া ভাজি, বাচ্চাদের জন্য ডিমভাজি, চিকেন কারি, আপেল জুস, আইসক্রিমসহ ব্যাপক ভুরিভোজনের পর আমরা চললাম বিখ্যাত পুনাখা জং-এর উদ্দেশে। চারপাশ পুরা দম বন্ধ করা সুন্দর-সবুজ পাহাড়, সবুজ গাছ, ছিমছাম রাস্তা-ঘাট, ছোট্ট শহর। পুরো পাহাড়ি পথে আমরা এক এক করে ছোট ছোট গ্রাম, ধানক্ষেত, ওক আর পাইনের বন, সারি সারি রডোডেন্ড্রন এর ঝাড় পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম।
পুনাখা জং অথবা পুংটাং ডেচেন ফোটরাং জং (দ্য প্যালেস অব গ্রেট হ্যাপিনেস অর ব্লেস)। দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম এই জং গড়েছিলেন জাবড্রুং নাওয়াং নামগিয়াল। ১৬৩৭-৩৮ সালে। জাবড্রুং ছাড়াও বিভিন্ন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতার পবিত্র স্মারক সংরক্ষিত আছে এখানে। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এখানেই ছিল ভুটান সরকারের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। ১৬৩৭ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত পুনাখা ছিল ভুটানের রাজধানী। এই পুনাখা জঙেই বর্তমান রাজা-রানির বিয়ে হয়েছিল ২০১১’র ১৩ অক্টোবর।
এখানে আমরা দেখি পচু আর মচু নদীর মিলন। পচু (ছেলে নদী) আর মচু (মেয়ে নদী) নদীর ঠিক মাঝখানেই এই বিশাল সুদৃশ্য পুনাখা জং, শহরের মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উপাসনালয় আর প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্র। এই দুই নদী মিলিত হয়ে পুনা সাং চু বা সংকোশ নাম নিয়ে কালিখোলাতে সীমানা পার হয়ে মিলেছে ব্রহ্মপুত্রর সঙ্গে। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই মঠ তথা কেল্লা পুনাখা জং বা পুনাখা মনাস্ট্রি। প্রবেশপথে পাথরের খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে বেশ কিছুটা, তার সঙ্গে জুড়ে আরও অনেকটা উঠেছে কাঠের সিঁড়ি। কাঠের সিঁড়িটা দেখলেই মনে হয় এটা জোড়া হয়েছে পরে। সিঁড়ি ছাড়াতে মূল প্রবেশপথ।
আমাদের বিশাল বাহিনী দেখে রক্ষীদের সাবধান বাণী, জোরে কথা বলা যাবে না। কে আর ভেতরে ঢুকে হল্লা করবে রে বাবা! অবশ্য বাচ্চারা সেই সাবধানবাণী মানেনি। ঢুকে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। সেটা ঘিরে দোতলা টানা ইমারত। রেলিঙে, স্তম্ভে কাঠের সুদৃশ্য নকশা। প্রাঙ্গণের মাঝখানে সাদা রঙের আরেকটা ভবন। ওপরে ওঠার সিঁড়ি দেখে উঠতে লাগলাম। কাঠের খাড়া সিঁড়ি । দেখে মনে হল এটাও পরেই লাগানো। ভাবতে চেষ্টা করলাম কাঠের সিঁড়ি বাদ দিলে কীভাবে ওপরে ওঠা সম্ভব। বোঝা গেল না। পাথরে দেয়ালে শীতল কাঠিন্য। ক্রমশ ওপরে উঠতে লাগলাম। দোতলা, তিনতলা । ওঠার পথে কয়েকজন লামার মুখোমুখি হলাম। কেউ কিছু বলল না আমাদের। উঠতে উঠতে এক জায়গায় এসে মনে হল আর ওঠার উপায় নেই। অতএব নামতে লাগলাম।
এরপর আমরা গেলাম পোচু নদীর ওপর ভুটানের সবচেয়ে দীর্ঘতম হ্যাংগিং ব্রিজ যা ৬৫০ ফিট লম্বা ও মাত্র ৫ ফিট চওড়া । হাওয়ায় দুলে ব্রিজের ওপর হেঁটে এ মাথা থেকে ওমাথা গেলাম। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে আসার পথে দেখলাম কাশফুল। শরতের ছোঁয়া দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। এরপর আমরা গিয়ে উঠলাম অত্যন্ত মনোরম ও আকর্ষণীয় Puna Tsangchhu Cottages, Wangdue. নদীর ধার ঘেঁষে এমন চমৎকার কটেজে গিয়েই আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি ঘুচে গেল। নদীর ধারে খোলা আকাশের নিচেই রয়েছে বসার ব্যবস্থা। আমরা ফ্রেশ হয়ে চা-কফি খেয়ে আড্ডায় বসলাম। সবে রাত হয়েছে। কটেজের এই ধারে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নদীর ধারে, পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট বাড়ির সব আলো জ্বলা দেখে মনে হলো-“তোমার সবুজ অন্ধকারে জোনাক জ্বলে ঘরে ঘরে,/নদীর সুরে সুর মিলিয়ে আমি এলাম তোমার দ্বারে/পাহাড় তোমার মাদকতায়, নদীর স্রোতের উচ্ছলতায়/পেলাম তোমায় আবার আমি আপন করে নতুন করে”
এরপর রাতের খাবারের বিরতি। রাতে খেলাম লাল চালের ভাত, এসপারাগাস স্যুপ, এমা ডাটসি (লম্বা লম্বা কাঁচা লঙ্কা ও চিজ দিয়ে বানানো), সামু ডাটসি (মাশরুম উইথ চিজ) আর চাউমিন দিয়ে। আবার আড্ডা। ইচ্ছে হচ্ছিল, সারারাত বসে কাটাই। কিন্তু পরদিন আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আবার পারো পৌঁছতে হবে। কাজেই রাত বারোটা অব্দি আড্ডা দিয়ে অবশেষে শয্যা গ্রহণ করতে হলো। রাতে একদিকে নদীর কলকল ধ্বনি, কুকুরের একটানা ঘেউ ঘেউ আবার হোটেলের কাঠের কটেজের চালে বৃষ্টির টুপটাপ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।