আজ ১০ ডিসেম্বর শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ৫০তম অন্তর্ধান দিবস। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের এই দিনে ঘৃণ্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আল বদর ও রাজাকার বাহিনীর বর্বররা তাকে তার চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়, এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশার প্রথম শিকার হন সিরাজুদ্দীন হোসেন।
তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক। বৃটিশ আমলের শেষভাগ থেকে শুরু করে তার সাংবাদিকতা জীবন স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যপ্ত। এই পুরো সময়কালে দেশের সকল আন্দোলনের সঙ্গে তার ছিল সরাসরি যোগাযোগ।
সিরাজুদ্দীন হোসেন তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এ দেশের বঞ্চিত মানুষের কথা অসাধারণ দক্ষতায় সংবাদপত্রের পাতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৯৬৬ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলীয় সম্মেলনে যোগদানের আগে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেনের হাতে এই সংক্রান্ত দলিলের কপি দিয়ে যান এবং তার পক্ষে প্রচারণা চালাতে অনুরোধ করেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন সেই অনুরোধ রেখেছিলেন এবং ইত্তেফাকে সে প্রচারণা দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ এই দেশে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করে গেছেন। সে সময় তার লেখা ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’, ‘ অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায়’ ধরনের উপ-সম্পাদকীয় এবং ‘এতদিনে’ শিরোনামে সম্পাদকীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। তিনি প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনসুলেটের গোপন রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক থাকা অবস্থায় মহান ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে তার সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে তার অসাধারণ কীর্তি বলে পরিগণিত।
শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন এদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক। ইত্তেফাকে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ফলে ১৯৬২ সালে ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ের কুখ্যাত ছেলেধরা দল ধরা পড়ে। মুক্তি পায় ৭২ জন শিশু।
তিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউট অ্যাওয়ার্ডের (আইপিআই) মনোনয়ন লাভ করেন। আইপিআই বুলেটিনেও জনাব হোসেনের এই সাফল্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন তৎকালীন সানডে টাইমস ও পরবর্তীতে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স।
শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের অসাধারণ হেডিং বাঙালি জাতির রক্তে আগুন ধরিয়ে দিত। ‘চিনিল কেমনে’, ‘সুকুইজ্জা কডে’, ‘জয় বাংলার’ জয়, ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’ এবং দুই পাকিস্তানের ভারসাম্যহীনতাকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করে যে হেডিং করেছেন, তা পাঠককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করলে তা বাংলার মুক্তিসনদ হিসেবে মানুষের মনে প্রোথিত করার জন্য অক্লান্ত কাজ করে গেছেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত ইত্তেফাকে ছয় দফার পক্ষে তুলনাহীন সাংবাদিকতা করেছেন তিনি।
সত্তরের নির্বাচনের সময় নানা বিরুদ্ধ স্রোতের স্বরূপ উন্মোচন করা ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অনবদ্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। মিশন জার্নালিজমের সবচেয়ে ফলদায়ক রূপ দেখা গেছে তার সাংবাদিকতায়।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন-এর পঞ্চাশতম অন্তর্ধান দিবসে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামে তার অবিস্মরণীয় অবদান সম্পর্কে নুতন প্রজন্মকে জানাবার জন্য বি-বার্তা টিভি চ্যানেল এবং শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন স্মৃতি পরিষদ যৌথভাবে “সিরাজুদ্দীন হোসেনঃ ইতিহাসের অনুঘটক” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
অনুষ্ঠানে মুল আলোচক থাকবেন ডঃ মোস্তফা সারওয়ার, এমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রাক্তন উপ-উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স এবং বর্তমান ডীন ও প্রাক্তন উপাচার্য ডেলগাডো কমিউনিটি কলেজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে ১০ ডিসেম্বর বাংলদেশ সময় রাত ৯টায়।
যশোরের খাজুরা উপজেলায় শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন সরকারী কলেজ কর্তৃপক্ষ আগামী ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন স্মরণে মিলাদ মাহফিল এবং আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে মসজিদে কোরানখানি এবং মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। চলমান করোনা দুর্যোগের কারণে এবার শহীদের বাসভবনে কোন অনুষ্ঠান রাখা হয়নি। পারিবারিকভাবে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনকে স্মরণ ও প্রার্থনা করা হবে