আজ আম্মার চলে যাবার দিন। বাইশ বছর আগে এদিন আমাদের ছেড়ে চলে যান আম্মা, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। আমেরিকার হাসপাতালে তার ক্যানসারের চিকিৎসা চলছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের ব্যস্ততা আর তার এর সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতায় তার শিডিউল মতো আমেরিকা যেতে দেরি হয়। এই সুযোগে ঘাতক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে তার শরীরে। সে কারণে সেবার আমেরিকা যাবার পর তার আর অবস্থার উন্নতি হয়নি।
ওই অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষার সময়েও তিনি তৈরি করতে থাকেন আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দিক নির্দেশনা, ঘোষণাপত্র। ওই ঘোষণাপত্রে তিনি আন্দোলনের দায়িত্ব দেশের তরুন সম্প্রদায় নতুন প্রজন্মের হাতে দিয়ে যান। নতুন প্রজন্ম সেই কর্তৃত্ব প্রথম পেয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের সময়। সেই গণজাগরণ মঞ্চ সেই কর্তৃত্ব পরে রাখতে পারেনি অথবা তা তাদের হাতে রাখতে দেয়া হয়নি।
শহীদ জননী যখন শেষবার আমেরিকায় যান তার মাথার ওপর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার করায় ক্ষুদ্ধ হয়ে এই মামলা তাকে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। শহীদ জননী যখন আমেরিকায় তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে খালেদা বিরোধী তুমুল আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ‘কৌশলগত শরীক’ জামায়াতও ছিল! সে অবস্থায় তিনি যদি দেশে থাকতেন তার জন্য তা খুবই বিব্রতকর হতো। কারণ শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গণ আদালত, গণ তদন্ত কমিশন দুটোই হয়েছিল। গণ তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের মঞ্চে শেখ হাসিনাও ছিলেন।
আবার আম্মা যখন আমেরিকায় মারা গেলেন তখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায়। জামায়াত আবার ফিরে গেছে খালেদা জিয়ার কাছে। কিন্তু তখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি! আবার আম্মার মৃত্যুর সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তার লাশ ঢাকায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রহণ, দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার সমর্থনে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমদ, হাসানুল হক ইনু, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন প্রমুখ তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ একটি দল।
এখনো মনে পড়ে তার মৃত্যুর খবর আসার দিনটির কথা। তার ছেলে জামীকে উদ্ধৃত করে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার রিপোর্ট দুটি এখনো কানে বাজে। জামী বলেন তার শেষ প্রস্থানটি শান্তিতেই হয়েছে। ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমের না ফেরার দেশে চলে গেছেন আম্মা। মৃত্যু সংবাদ আসার পর থেকে ভারাক্রান্ত আমরা তার সন্তানেরা অপেক্ষায় কখন আসবে তার লাশ। জনকন্ঠের হয়ে আমি পুরো ইভেন্টটি অনুসরণ করছিলাম। বিমান বন্দরে তার লাশ গ্রহণ, এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি ‘ক্ষনিকা’য় তার লাশ নিয়ে আসা, সবশেষে মিরপুরে মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে তার চিরশয্যা।
এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে লাশ আনার পর লাইনে হেঁটে আম্মার মুখটি সবাইকে দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়। ওই সময় সিদ্ধান্ত ছিল আম্মার মৃত মুখের ছবি তোলা যাবে না। আম্মার যে ছবি, চেহারাটি আমাদের স্মৃতিপটে আছে সেটিই থাক। দেশের প্রধান সব সংবাদপত্রের ফটো সাংবাদিকরা সিদ্ধান্তকে সম্মান করে আম্মার মৃত মুখের ছবিটি তোলেননি। কিন্তু সেই সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তটি ভঙ্গ করে আজকের কাগজ! তাদের পক্ষে একজন কৌশলে আম্মার মৃত মুখের ছবি তোলে এবং তা পত্রিকাটিতে ছাপাও হয়। এ বিষয়টি তখন আম্মার গুণমুগ্ধ অনুসারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।
নানা ঘাত প্রতিঘাতের সময়েও স্বস্তি আজকের বাংলাদেশে আম্মার স্বপ্ন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে হচ্ছে। এরমাঝে কার্যকর হয়েছে বেশ ক’জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। সবাই এখন মীর কাসেমের ফাঁসির অপেক্ষায়। এরজন্যে শেখ হাসিনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী সরকারিভাবে পালন করা হচ্ছেনা কেনো? এ আমাদের রাষ্ট্রীয় দৈন্য।
এই দৈন্য দূর করা দায়িত্বটিও শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। কারণ তাকে সম্মান দেয়াটা মানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, শহীদদের, শহীদ জননীদের সম্মান দেয়া হয়। তিনি তাদের সবার সম্মাননার প্রতীক। আম্মার মৃত্যুর দিনটিতে তার সন্তানদের পক্ষে অনেক ভালোবাসা। না ফেরার দেশে ভালো থাকুন আম্মা। নীলিমা ইব্রাহিমের ভাষায় আজ তোমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি:
“অনন্তকালের তরে
গৌড়মন মধু করে
পান করি করিবেক
যশস্বী তোমারে।”
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)