বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত দলের নাম ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। যারা তৎকালীন সময়ে বাংলার মানুষের কাছে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। এই ক্র্যাক প্লাটুনের একজন অন্যতম সক্রিয় সদস্য ছিলেন শহিদ বদিউল আলম (বীর বিক্রম)। তাকে নিয়ে সম্প্রতি একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে রাজধানী উত্তরার ‘রচয়িতা’ প্রকাশনী থেকে।
রুবিনা হোসেনের গ্রন্থনায় স্মারকগ্রন্থটির নাম ‘দীপ্র তপন- শহিদ বদিউল আলম স্মারকগ্রন্থ’, এর প্রচ্ছদ করেছেন লুৎফুল হোসেন। বইটি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন লুৎফুল হোসেন ও রুবিনা হোসেন। যা উৎসর্গ করা হয়েছে শহিদ বদিউল আলমের বাবা আবদুল বারী এবং মা রওশন আরা খানমকে।
স্মারকগ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করার ইচ্ছে থাকলেও করোনার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি বলে জানান রুবিনা হোসেন। স্মারকগ্রন্থটি নিয়ে প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ক্র্যাক প্লাটুনের অবদান অবিস্মরণীয়। বদিউল আলম ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুন খ্যাত গেরিলা বাহিনীর অন্যতম মেধাবী এবং দুঃসাহসী যোদ্ধা, যার বীরত্বগাথা ইতিহাস হয়ে থাকবে। তাঁকে নিয়ে আগামি প্রজন্মকে যেন কোনো বিভ্রান্তিকর ইতিহাসের সম্মুখিন না হতে হয়, সে জায়গাতে প্রকৃত ইতিহাস জানতে কিছুটা সহায়ক হবে স্মারকগ্রন্থটি।
গ্রন্থটিতে স্মৃতিকথা দিয়ে যারা সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রুবিনা হোসেন বলেন, স্মারকগ্রন্থটির জন্য শহিদ বদিউল আলমের সহযোদ্ধা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী এবং পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ করে তার সম্পর্কে স্মৃতিকথা লেখার অনুরোধ জানালে সকলেই আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। যারা তাদের মূল্যবান স্মৃতিকথা দিয়ে এই প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের সবার প্রতি রইল গভীর কৃতজ্ঞতা।
এদিকে বইটির আরেক সম্পাদক লুৎফুল হোসেন প্রাককথনে বলেন, নিরলস ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গোটা উদ্যোগটিকে সম্ভব করলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বহুবিধ প্রচার-প্রকাশনা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রুবিনা হোসেন। প্রকাশনাটি বাস্তবে সম্ভব হয়ে উঠল বদি ভাইয়ের অনুজ সাইফুল আলমের একান্ত ইচ্ছায়। এই গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ বাস্তবায়নের সকল সূত্রকে এক মালায় গাঁথার অনন্য কাজটি করার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য সানাউল্লাহ লাবলুর।
তিনি বলেন, গ্রন্থটির বিন্যাসে একটা জটিল অধ্যায় ছিল কার লেখা কোথায় থাকবে, এই বিবেচনাটি। সঙ্গত কারণেই বদি ভাইয়ের মা এসেছেন সবার আগে। তারপর তার সহযোদ্ধা, সহপাঠী, বন্ধু ও আত্মীয়-পরিজনরা একে একে। বেশির ভাগ লেখাই এই স্মারকগ্রন্থের জন্য সরাসরি লেখা। সেই সাথে কিছু লেখা ঘটনার সময়, চরিত্র, ও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় পূর্বপ্রকাশিত বিভিন্ন উৎস থেকে সংকলিত। আশা করি গ্রন্থবিন্যাসের ধরনটি সকল পাঠকের কাছে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে। পাশাপাশি আশাবাদ, এটা বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম স্মারকগ্রন্থের মলাটি-বৃত্ত ছাপিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল হিসেবে জায়গা করে নেবে।
স্মারকগ্রন্থটির ফ্ল্যাপে শহিদ বদিউল আলম (বীর বিক্রম) সম্পর্কে লেখা হয়, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা ঢাকা শহরে গেরিলা-পদ্ধতিতে কতগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক অপারেশন সম্পন্ন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বদিউল আলম বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে-দুঃসাহসিক অপারেশনগুলাে করেছিলেন, তা তার গভীর দেশপ্রেম, অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং অসীম সাহসিকতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। ৮ আগস্ট পরিচালিত অসাধারণ সফল অভিযান ছিল ‘অপারেশন ফার্মগেট’। এর সাথে জড়িত প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা ফার্মগেট অপারেশন সম্পাদনে বদিউল আলমের বিশেষ ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। ২৫ আগস্ট সংঘটিত ধানমন্ডি অপারেশনটি ছিল যে কোনাে ইংরেজি মুভির কাল্পনিক কাহিনিকেও হার মানিয়ে দেয়ার মতাে নিখুঁত ও দুর্ধর্ষ।
সে-সব যুদ্ধদিনের স্মৃতি এবং শৈশব থেকে তারুণ্যের টগবগে সখ্য সময় ঘিরে টুকরাে টুকরাে স্মৃতির জোনাকি শব্দের বিস্তারে মেলে ধরে এই স্মারকগ্রন্থটি সম্ভব ও সমৃদ্ধ করেছেন বদিউল আলমের বন্ধু-পরিজন-সহযােদ্ধারা। সেই সুবাদে গ্রন্থটি হয়ে উঠল ইতিহাসের একখানা দলিল।