বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর হঠাৎ করে কূটরাজনীতি, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, শোডাউন, সরকারের সঙ্গে আলোচনার ইচ্ছা, ভাস্কর্য ভাঙচুর, ভাঙচুরকারীদের প্রতি সমর্থন ফিরিয়ে নেওয়ার সবকিছু পূর্ব পরিকল্পনার ফসল। এই পরিকল্পনা যাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে তিনি মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নতুন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব তিনি।
মামুনুলের রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তার আরও পরিচয়ের মধ্যে রয়েছে তিনি প্রয়াত মাওলানা আজিজুল হকের পুত্র। মামুনুলের ভাই মাওলানা মাহফুজুল হক বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নামে পরিচিত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) নতুন কমিটির মহাসচিব। বেফাকের মহাসচিব পদে মাহফুজুল হক নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে খেলাফত মজলিসের মহাসচিবের পদ ছাড়তে হয় এবং আলোচিত এই রাজনৈতিক দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্বে আসেন এই মামুনুল হক। মামুনুল হকের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে দেশের আলেম ওলামাদের কাছে। তিনি ওয়াজ করে থাকেন, ঢাকার একটি মাদ্রাসার দায়িত্বেও আছেন তিনি। সাংগঠনিকভাবে তার পরিচিতি ও প্রভাব রয়েছে। মাহফিলের মঞ্চে উত্তেজনা ছড়াতে পারেন তিনি। এই হিসেবে তার ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা নেহায়েত কম না।
গত সেপ্টেম্বরে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারি মাদ্রাসায় যে ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো ঘটেছে সেখানে শফির বিরুদ্ধপক্ষ আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর পক্ষে ছিলেন মামুনুল হক। ওখানে ছাত্রবিক্ষোভের নামে আহমদ শফিকে যেভাবে হেনস্থা করে তাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে সেখানে অন্য অনেকের সঙ্গে দায়ি করা হচ্ছে মামুনুল হককেও। আহমদ শফির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও এরপর মৃত্যুতে তিনি দায়ি না বলে দাবি করলেও হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে তিনি যে জুনাইদ বাবুনগরীর পক্ষে ছিলেন সেটা নিজেই স্বীকার করেছেন। বাবুনগরীর পক্ষে তিনি বাবুনগরেও গেছেন, হাটহাজারির ছাত্রবিক্ষোভকে তিনি অন্যায় কাজ বলেননি। হাটহাজারিতে নজিরবিহীন ওই ঘটনার সময়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের দ্বারা কোরআন শরিফকেও অসম্মান করা হয়েছে, বয়সের ভারে ন্ব্যূজ ও অসুস্থ আল্লামা শফিকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, অসুস্থ আহমদ শফিকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছিল বিভিন্ন মাধ্যমে। অস্বীকার করলেও ওসবের সঙ্গে, ওসবের প্ররোচনা ও সমর্থনের অভিযোগ আছে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে।
ছাত্রবিক্ষোভ ও হাটহাজারি মাদ্রাসার কর্তৃত্ব হারানোর পর মারা যান আল্লামা শাহ আহমদ শফি। তার জানাজায় জামায়াতে ইসলামি নেতাদের উপস্থিতি, খাটিয়া বহন করা নিয়ে দেশের কওমিপন্থি আলেমদের মধ্যে যে আলোচনা শুরু হয় তার জবাব অবশ্য দিয়েছেন মামুনুল হক। তিনি দাবি করেছেন আহমদ শফি জানাজায় জামায়াত নেতাদের উপস্থিতি ও খাটিয়া বহনের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন। গত মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুল হক বলেছেন, তিনিও অন্য অনেকের মত হাটহাজারি মাদ্রাসায় আহমদ শফির জানাজায় ঢাকা থেকে যাওয়া এক মেহমান ছিলেন। জানাজায় জামায়াত নেতাদের খাটিয়া বহনকে তিনি আয়োজকদের দুর্বলতা হিসেবে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন।
প্রসঙ্গের অবতারণা মূলত সাম্প্রতিক সময়ে নানা আলোচনার কেন্দ্রে তার থাকার কারণেই। এই আলোচনার উপলক্ষ হুট করে দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মভিত্তিক নেতা ও সংগঠনগুলোর রহস্যজনক বিরোধিতা। স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মুজিববর্ষ হিসেবে উল্লেখ করা এই সময়ে দেশে নানা আয়োজনে চলছে উদযাপন। এই উদযাপনের অংশ হিসেবে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে চলছে নানা জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজও। রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন এক ভাস্কর্য, পদ্মাসেতুর একপ্রান্তের নির্মাণাধীন ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে মামুনুল হক, ফয়জুল করিম চরমোনাই পিরসহ আরও কিছু মাওলানা ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে সেটা নির্মাণ বন্ধ করার দাবি এবং নির্মাণ বন্ধ না হলে ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। এখানে এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধংদেহী মাওলানা মামুনুল হক। তাদের প্ররোচনায় সারাদেশে ভাস্কর্য বিরোধী একটা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। তাদের উসকানিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় কথিত তৌহিদি জনতা ব্যাপক শোডাউনও করেছে। ইত্যবসরে কুষ্টিয়ার বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন একটা ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলেছে ধর্মীয় দুর্বৃত্তরা। এই দুর্বৃত্ত চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে মামুনুল হক, চরমোনাই পীর ও জুনাইদ বাবুনগরীদের ভাস্কর্য বিরোধি বক্তব্যে প্ররোচিত হয়েই তারা এই কাজ করেছে। ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন যে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ সেটা নিজেই স্বীকার করেছেন মামুনুল হক। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে তারা প্রথমে মাঠ গরম করতে চেয়েছেন। মাঠ গরমের জন্যে মামুনুল হক ও ফয়জুল করিম চরমোনাই পির দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা রাজধানীর ধোলাইপাড়ে ব্যাপক শোডাউন করেন, ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলার ধৃষ্টতাপূর্ণ হুমকিও দেন।
বাংলাদেশে ভাস্কর্য, দেশে-দেশে ভাস্কর্য, মুসলিম বিশ্বে ভাস্কর্যের অস্তিত্ব নতুন কিছু নয়। নতুন নয় তেমনি ধর্মের নামে বাংলাদেশে এই ভাস্কর্যের বিরোধিতাও। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও বাংলাদেশে নতুন করে গড়ে ওঠছে না। তবে এবার সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধিতা এবং সেটা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলার হুমকি নতুন করে এসেছে। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে আজন্ম বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের বিরোধিতার সঙ্গে নতুন করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর পর দেশের আলেম ওলামাদের সঙ্গে সরকারের নতুন করে যোগাযোগ স্থাপনের অভীপ্সা এখানে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। আহমদ শফি তার জীবনের শেষাংশে সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তার প্রস্তাবে সরকার রাজি হয়ে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমানের স্বীকৃতি দিয়েছে। শফির উপস্থিতিতে আলেম ওলামারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দিয়েছে, এবং সেই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ বলেও উপাধি দিয়েছে তারা।
আহমদ শফির বাইরে হেফাজতের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ছিলেন মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী। কিন্তু বাবুনগরীর সঙ্গে সরকারের সে ধরনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক নেই। জনশ্রুতি রয়েছে তিনি সরকার বিরোধি ধর্মীয় নেতা এবং বিএনপি-জামায়াত ঘনিষ্ঠ। আহমদ শফিকে সরাতে হাটহাজারি মাদ্রাসায় ছাত্রবিক্ষোভের ঘটনা তাকে সরকার থেকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এরপর হেফাজতে ইসলামে শফি অনুসারীদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করার পর বাবুনগরীর প্রতি সরকারের দূরত্ব আরও বেড়েছে। তার ওপর ফ্রান্সের একটি বিশেষায়িত ম্যাগাজিনে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন আঁকা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভে জুনাইদ বাবুনগরীর নেতৃত্ব ও উপস্থিতি আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশের এই বিক্ষোভ বিশ্বমিডিয়ায় স্থান পেয়েছে। এনিয়ে ধর্মীয় সংগঠনগুলো সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করলেও সরকার অনুমিতভাবে তাদের নানা দাবি আমলে নেয়নি, আলোচনায়ও বসেনি।
জুনাইদ বাবুনগরীও বয়সের ভারে ন্ব্যূজ। সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমিও সরকার ঘনিষ্ঠ নন; তিনি মাঠের শক্তিমানও কেউ নন। তাদের বাইরে এখন পর্যন্ত হেফাজতে আর শীর্ষ নেতা কেউ না থাকার সুযোগটা এখানে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছেন মাওলানা মামুনুল হক। বড় ভাই মাহফুজুল হক বেফাকের মহাসচিবের দায়িত্ব নিতে রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের পদ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে সরে যাওয়ার কারণে দলেও শক্তিশালী অবস্থান গড়তে পেরেছেন মামুনুল হক। তার ওপর হেফাজতের নতুন কমিটির যুগ্ম মহাসচিবের পদ পাওয়ার পর হেফাজতের ভবিষ্যৎ শীর্ষ নেতা হওয়ার জন্যে তিনি একটা প্ল্যাটফরম খুঁজছিলেন। এরই অংশ হিসেবে অন্যদের নিয়ে ভাস্কর্যের রাজনীতি শুরু করে নেতৃত্ব চলে আসেন তিনি। এই ভাস্কর্য রাজনীতিতে ধর্মযোগ করে তিনি দেশের আলেমসমাজসহ ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগকে ভালোভাবেই কাজে লাগান। ফলে বহুধাবিভক্ত আলেমসমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ স্রেফ ধর্মীয় অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে এই ফাঁদে পা দেয়। এই ফাঁদে আবিষ্ট জনদের নিয়ে তিনি আলেমসমাজের শক্তিমান নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন।
যদিও শেষ পর্যন্ত মামুনুল হক কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভাঙার পর এর প্রতিবাদে সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলার আবেদন এবং জায়গায়-জায়গায় তাদের ওয়াজ মাহফিল বন্ধ হতে শুরু হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা হলেও সুর পাল্টেছেন। বলছেন, ভাস্কর্য ভাঙার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। তবে এই তিনিসহ অন্য ভাস্কর্য বিরোধীরাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছিলেন।
মামুনুল হক, ফয়জুল করিম চরমোনাই পীর ও জুনাইদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের এই মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা মামুনুল হককে হেফাজতে ইসলামের অন্যতম শীর্ষ নেতায় পরিণত করেছে। হেফাজতের পরের কমিটিতে তার পদোন্নতি যে নিশ্চিত এটা এখনই বলা যায়। এও বলা যায়, তিনি সফল হয়েছেন যদিও সরকার ঘনিষ্ঠ হয়ে আর্থিক সুবিধাদি গ্রহণের সুযোগটা তার হবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না।
ফ্রান্সের ঘটনায় বাংলাদেশে বিক্ষোভ, সরকারকে চাপে ফেলে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে বিবৃতি দেওয়ানোর মত হঠকারি যে দাবি মামুনুল হকরা করে এসেছিলেন সেটা সফল হয়নি। ধারণা করা যায় ধর্মের অপব্যাখ্যায় আন্দোলনের চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়াও তাদের সফল হবে না। এই দুই ঘটনায় বিভ্রান্তিতে হাবুডুবু খাওয়া দেশের একটা বড় অংশের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারলেও মামুনুলরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেও শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব জায়গায় ব্যর্থ হলেও মামুনুল হক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন নিজেকে কওমিপন্থি আলেমদের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনে। দিনশেষে এই প্রাপ্তি দেখে হয়ত তিনি তৃপ্ত, এটাই হয়ত ছিল তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)