সাধারণ নির্বাচনে অভাবনীয় বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন ড. মাহাথির মোহাম্মদ। রাজধানী কুয়ালালামপুরে ইসতানা নেগারা প্যালেসে যখন মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছিলেন, তখন বাইরে তার সমর্থকেরা পতাকা উড়িয়ে ও উল্লাস ধ্বনি দিয়ে জয়োৎসব করেন।
১৫ বছর আগে ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা খ্যাত মাহাথির।
১৯৮১ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলো তার দল।
আর ৯২ বছর বয়সে, বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক নেতা নির্বাচিত হওয়ার পথে নিজের পুরানো দল বিএন’কেই হারিয়েছেন মাহাথির।
স্বেচ্ছা অবসর ভেঙে সাবেক সহকর্মী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তার বিরুদ্ধে মাঠে নামেন মাহাথির। ক্ষমতাসীন নিজ দল বিএন ছেড়ে যোগ দেন পাকাতান হারাপান (পিএইচ) জোটে।
২০০৮ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন নাজিব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক জনগণের রায় মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও এমন রাজনৈতিক ‘অভ্যুত্থানের’ পর ক্ষমতার হস্তান্তর সহজ হবে না বলেই অনেকের আশঙ্কা ছিলো।
মাহাথিরের রাজনৈতিক দলসহ চার রাজনৈতিক দলের জোট পাকাতান হারাপান। দল চারটি আনুষ্ঠানিকভাবে জোট গঠন করে নির্বাচন করেনি, করেছে পিপল’স জাস্টিস পার্টি (পিকেআর)-এর প্রতীক নিয়ে।
আর তাই মাহাথিরের শপথ গ্রহণ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিলো। কারণ চারটি দলের কোনোটিরই এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো না।
তাই কে সরকার গঠন করবে, তা নির্ধারণের বিষয়টি মালয়েশিয়ার রাজা ইয়াং দি-পেরতুয়ান আগং-এর সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
রাজপ্রাসাদ থেকে জানানো হয়েছিলো, বৃহস্পতিবার নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নিতে পারবেন না। তবে তখন এর স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেয় হয়নি।
সাধারণ নির্বাচনের অফিসিয়াল ফলাফলে দেখা যায়, বিরোধী দল পাকাতান হারাপান ২২২ টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনে জয় লাভ করেছে। বিএনের দখলে যায় ৭৯টি আসন।
এর আগে মাহাথির জানিয়েছিলেন, তার জোট কোন প্রতিশোধ নিতে চায় না। তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
নির্বাচনে জয়ের পর মাহাথির দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, “কিন্তু জয়ীদের জন্য কোন ছুটি নেই।”
তবে এবার দুই বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না মাহাথির। কেননা বিরোধী দলের নেতৃত্ব নেওয়ার চুক্তির সময় নির্বাচনে জয়লাভ করলে আনোয়ার ইব্রাহিমকে মুক্ত করার এবং দুই বছরের মধ্যে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সম্মত হয়েছিলেন তিনি।
নাজিবের পরাজয়ের কারণ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের পরাজয়ের পেছনে কারণ মূলত অর্থনীতি বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। দেশটিতে জীবনধারণের ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে, জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সেবার ওপর সরকার নতুন নতুন কর আরোপ করেছে।
এছাড়া সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেশটিতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় দুর্নীতি। বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে নাজিব রাজাকের গঠন করা একটি বিশেষ তহবিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তা ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠে।
নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধেও ৭০ কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। তবে নাজিব বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন। কোনরকম অনিয়মের অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়।
কিন্তু আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে তার ও এই তহবিলের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে, যা আন্তর্জাতিক বিশ্বে মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
এই দুর্নীতির অভিযোগের পরই ২০১৬ সালে বিএন ছেড়ে পাকাতান হারপানে যোগ দেন মাহাথির। তখন তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতিকে সমর্থন দেওয়া একটি দলের সাথে যুক্ত থাকা তার জন্য বিব্রতকর। পরে জানুয়ারিতে তিনি ঘোষণা দেন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আবারও লড়াই করার।
আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাহাথির
১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মাহাথিরের শাসনামলে মালয়েশিয়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। সেসময় মালয়েশিয়া ‘এশিয়ান টাইগার’দের একটি দেশ হয়ে উঠে। ৯০ এর দশকে যেসব দেশ তাদের অর্থনীতির দ্রুত বিস্তার দেখেছে তারাই এই গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও অর্থনৈতিক সাফল্য মাহাথিরকে মালয়েশিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে।
মাহাথিরের সবচেয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপটি ছিলো সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে। আনোয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন।
অনেকের অভিযোগ এজন্যই দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে তাকে বরখাস্ত ও দ্বিতীয় অভিযোগে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
চ্যালেঞ্জ অনেক
পরের সকালটি হবে মালয়েশিয়ার জন্য একটি নতুন পরিস্থিতির, দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্ষমতার পালাবদল দেখবে তারা। যদিও তাদের নতুন নেতা অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু তবুও অনেক অজানা রয়েই গেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশ পরিচালনা করা এবং সরকারের সকল ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা বিএন কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে?
মূলত নাজিব রাজাককে উৎখাতের অভিপ্রায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া একটি অসম জোট কীভাবে সরকারে একসাথে কাজ করবে?
কারাগারে বন্দি বিরোধী দলীয় নেতা আনেয়ার ইব্রাহিমের ক্ষমা পাওয়ার বিষয়টি কতটা নির্বিঘ্নে ঘটবে? এবং কিভাবে পরবর্তীতে মাহাথির ২ বছরের মধ্যে আনোয়ারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে?
নাজিব রাজাক ও তার বিলাসি জীবন কাটানো স্ত্রীর সাথে কেমন আচরণ করা হবে, তারা দুজনই কি দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হবেন?
এমন অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে মাহাথিরের মালয়েশিয়াকে।