চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শপথের দ্বিধা; কয়েকটি প্রশ্ন

বিএনপির পাঁচ এবং তাদের শরিক গণফোরামের দুজন সংসদ সদস্যের শপথ ইস্যুতে যেসব কাণ্ড/নাটক ঘটেছে বা ঘটছে, তা দেশের সংসদীয় ইতিহাসে বিরল। আবার দেশের অন্যতম প্রধান একটি দলের মহাসচিবের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে শপথ না নেয়া আরও বিরল।

কেন এসব বিরল ঘটনা ঘটছে তার নির্মোহ বিশ্লেষণ যেমন প্রয়োজন, তেমনি এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও নেতৃত্ব নিয়ে যেসব প্রশ্ন বহুদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সেসব আরও বেশি ঘনীভূত হলো কি না, সে প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি ও তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বলে আসছিলো তারা এই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিএনপির যে ৬ এবং গণফোরামের দুজনসহ জোটের মোট ৮ জন প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, তারা শপথ নেবেন না। কেননা, শপথ নিলে এই সংসদকে বৈধতা দেয়া হবে।

তারা এই সংসদকে অবৈধ মনে করেন। কিন্তু দেখা গেলো দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথমে গণফোরামের সুলতান মনসুর ঠিকই শপথ নিলেন এবং দল থেকে তাকে বহিস্কার করা হলো। এরপর শপথ নেন গণফোরামের অন্য বিজয়ী প্রার্থী মোকাব্বির খান।

তাকে বহিস্কার করা না হলেও দলের ভেতরে তিনি সমালোচিত হন এমনকি তিনি মতিঝিলে দলের প্রধান ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে দেখা করতে গেলে তিনি দেখা তো দেনইনি বরং মোকাব্বির খানকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে বলেছেন। অথচ সেই মোকাব্বির খানকে পাশে নিয়েই ২৬ এপ্রিল গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন কামাল হোসেন।

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? শোনা যাচ্ছিলো মোকাব্বির খানকে শোকজ করা হবে। কারণ দর্শানো নোটিশও নাকি প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেটি তাকে দেয়া হয়নি। দলের এসব কর্মকাণ্ডকে ‘স্ববিরোধী’ উল্লেখ করে বিশেষ কাউন্সিল থেকে বেরিয়ে যান গণফোরামের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিক।

ওইদিন রাতে তিনি আমাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেমন এককভাবে শেখ হাসিনার, বিএনপি যেমন এককভাবে খালেদা জিয়ার এবং জাতীয় পার্টি যেমন এককভাবে এরশাদের কথামতো চলে, গণফোরামও এখন এককভাবে ড. কামালের কথায় চলে। এই দলের ভেতরে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই।’

দেশের কোন দলের ভেতরে কতটুকু গণতন্ত্র আছে কিংবা কোন দলে দলীয় প্রধানের কর্তৃত্ব কতটুকু সেটি এক বিশাল তর্ক। সেই প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং আমরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারি।

১. ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা এবং এই সংসদকে বৈধতা দিতে বিএনপি ও তাদের জোটের এমপিরা শপথ নেবেন না বলে জানানোর পরও কেন মির্জা ফখরুল ছাড়া সবাই শপথ নিলেন? তাহলে কি তারা একাদশ সংসদকে বৈধতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য বলেছেন, নির্বাচিত সবাই শপথ নিলেও এই সংসদ বৈধতা পাবেন না। এটিও একধরনের স্ববিরোধিতা।

২. বিএনপির তাদের জোটের ৮ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৭ জনই শপথ নিলেন। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিলেন না কেন? তিনি বলেছেন, তাদের দলের এমপিদের শপথ নেয়া রাজনীতিতে চমক এবং তাদের কৌশলের অংশ। তার দলের ৫ জন এমপির শপথ নেয়া যদি কৌশল হয়, তাহলে তার নিজের শপথ না নেয়া কোন কৌশলের অংশ?

৩. খোদ বিএনপির মহাসচিবই জানিয়েছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শ/নির্দেশেই বিএনপির এমপিরা শপথ নিয়েছেন। যদি তাই হয় তাহলে তিনিই কি মির্জা ফখরুলকে শপথ না নিতে বলেছেন?

৪. যদি সুদূর লন্ডন থেকে তারেক রহমান শপথ নেয়ার নির্দেশ বা পরামর্শ দেন, তাহলে ঢাকা শহরের একটি কারাগারে বন্দি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কী করছেন? ভোটের আগে-পরে তার সঙ্গে দলের নেতারা একাধিকবার দেখা করেছেন।

শপথের বিষয়ে তার মতামত কী? তিনি যদি শপথের নির্দেশ বা পরামর্শ দিতেন সেটি নিশ্চয়ই দলের নেতারা সাংবাদিকদের জানাতেন। তার মানে তিনি শপথ গ্রহণের পক্ষে মতামত দেননি। অর্থাৎ দলের সমস্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন আসলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান; তাই কি?

৫. বিএনপির জাহিদুর রহমান শপথ নেয়ার পরদিনই তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অথচ এর কদিন পরেই বলা হলো বিএনপির এমপিরা তারেক রহমানের নির্দেশে শপথ নিয়েছেন। তাহলে জাহিদুর রহমানকে বহিষ্কার করা হলো কেন? তার মানে জাহিদুর রহমানের শপথ গ্রহণ পর্যন্ত এ বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত ছিল না।

শেষদিনে এসে তাদের মনে হলো যে বাকিদেরও শপথ নেয়া দরকার? এখন কি জাহিদুর রহমানের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে? বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলেই কি জাহিদুর রহমান বিএনপিতে ফিরে যাবেন?

৬. বিএনপি বলেছে, এমপিদের শপথ গ্রহণ তাদের কৌশলের অংশ। তারা ন্যূনতম কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। আবার মহাসচিব বলেছেন যে কোনো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। তার মানে কি এই যে, বিএনপি বহুদিন ধরেই যে দোটানা আর দোদ্যুলমানতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটি আরও একবার স্বীকার করে নিলেন খোদ মহাসচিব।

কোনো সিদ্ধান্ততই চূড়ান্ত নয় বলে মির্জা ফখরুল কী ইঙ্গিত করলেন? তাদের এমপিরা সংসদে যাবেন এবং সময়-সুযোগ মতো সংসদ বয়কট ও বর্জন করবেন?

খালেদা৭. সরকারের সাথে বিএনপির একটি সমঝোতা হচ্ছে বলে অনেক দিন ধরেই গুঞ্জন ছিল। কী সেই সমঝোতা? কখনো শোনা গেছে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি, কখনো তার জামিন। কিন্তু বিএনপি বরাবই এসব গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়েছে। শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে কি সেই গুঞ্জন আরেকটু হালে পানি পেলো?

যদি শিগগিরই খালেদা জিয়া জামিনে কিংবা প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে কিংবা দেশের ভেতরেই তার পছন্দের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন, তাতেও বোধ করি এখন আর দেশের মানুষ বিস্মিত হবে না।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, শপথ নেয়ার দিনই সংসদে যোগ দিয়ে বিএনপির এমপি হারুনুর রশিদ নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন এবং সেখানে নানা ইস্যুতে সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রশংসাও করেছেন।

তিনি শেখ হাসিনাকে যেভাবে সমীহ করে কথা বলেছেন, মুখ ফসকে তার দুয়েকবার ‘নেত্রী’ শব্দটিও বেরিয়ে গেছে (যেরকমটি বলেন আওয়ামী লীগের এমপিরা), তাতে মনে হয়েছে সরকারের সাথে কোনো একটা সমঝোতা ঠিকই হয়েছে। হারুনুর রশিদ তার বক্তৃতার একটা বড় অংশজুড়েই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এবং মানবিক বিবেচনায় হলেও তাকে জামিনে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান এবং বারবার তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

নবম ও দশম সংসদের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুবাদে বলতে পারি, সংসদে এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিএনপির কোনো সংসদ সদস্য এমনভাবে, এমন টোনে বক্তৃতা দিয়েছেন বলে আমার অন্তত মনে পড়ে না। বিএনপি জোটের শরিক নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না অবশ্য বলেছেন, বিএনপির সাথে সরকারের সত্যিই কোনা সমঝোতা হয়ে থাকলে তা খোলাখুলিভাবে জানানো উচিত।

৮. বিএনপি ও তার জোটের ৮ জন এমপি শপথ নিলেন। কিন্তু এমপি হয়ে সংসদে যেতে পারলেন না একা মির্জা ফখরুল। তিনি কি ‘বলির পাঁঠা’ হলেন নাকি তাদের কথিত কৌশল ও চমক বোঝানোর জন্যই তাকে শপথের বাইরে রাখা হলো?

৯. বিএনপির এমপিদের শপথ নিতে শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন? দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ছাড়া কেউ নির্বাচিত হননি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে অথচ মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতো নেতারা নির্বাচিত হবেন না, এটি খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। ফলে বিএনপির সংসদের যওয়ার বিষয়ে এই সিনিয়র নেতাদের অনীহাই স্বাভাবিক।

পক্ষান্তরে যে ৬ জন এমপি হয়েছেন তাদের মধ্যে ফখরুল ছাড়া কেউই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন। তাহলে কি বিষয়টা এরকম যে, ভোটে হেরে যাওয়া সিনিয়র নেতাদের চাপেই এতদিন নির্বাচিতরা শপথ নেননি?

১০. বিএনপি ঠিক কী কৌশলের কারণে শপথ নিলো? মির্জা ফখরুল বলছেন, তারা ন্যূনতম কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। তাহলে এই উপলব্ধিটা হতে তাদের সংসদের যাত্রা শুরুর পর তিন মাস সময় লাগলো কেন? তাদের এই উপলব্ধি কি জোটের ভেতরে আলোচিত হয়েছে বা এটি কি তাদের জোটবদ্ধ সিদ্ধান্ত?

এটি যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জোটবদ্ধ সিদ্ধান্ত নয় সেটি মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্যে পরিস্কার। প্রশ্ন হলো, তারা জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেন অথচ কৌশল ঠিক করছেন একা একা, এর কী ব্যাখ্যা? বিএনপির আরেকটি শরিক ২০ দলীয় জোট। বিএনপি যে কৌশলের কথা বলছে, সেই কৌশল কি ২০ দলের শরিকরা জানে বা শপথ ইস্যুতে যেসব কাণ্ড ঘটছে, সে বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের অবস্থান কী?

বিশেষ করে এলডিপির অলি আহমেদ কী ভাবছেন? যদি এই কৌশল বিএনপির একার হয়, তাহলে বুঝতে হবে বিএনপির জোটবদ্ধ রাজনীতির ভবিষ্যৎ খুব সুখকর নয়।

দ্বিতীয়ত এই কৌশল যদি এককভাবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঠিক করে থাকেন, তাহলে এটিও মনে রাখা দরকার, এই কৌশল আখেরে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে খুব বেশি সুবিধা দেবে না। বরং বিএনপি যে একটি সংকট থেকে আরেকটি সংকটের গর্তে গিয়ে পড়ছে, এই ঘটনা তারই পৌনঃপুনিকতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)