চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শতবর্ষী সাংসারেক জনিক নকরেক

বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, জাতিসত্তা সম্পর্কে আগ্রহ সেই ছোটকাল থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সেই আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। এরপর বৈচিত্র‍্যময় সংস্কৃতি, ভাষা, জাতিসত্তা সম্পর্কে জানতে, তাদের সাথে মিশতে ঘোরাও হয়েছে কিছু কিছু জায়গায়। কারো সাথে হয়তো গভীরভাবে মেশা হয়েছে, কারো সাথে হয়নি। কিন্তু যতটুকুই মিশেছি কোথাও আন্তরিকতার কোন কমতি ছিল।

তেমনই এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে একাকার হয়ে মিশে এসেছি এই গতমাসেই। টাঙাইলের মধুপুরে।সে গল্প আরেকদিন হবে। আজ কথা হোক শতবর্ষী সাংসারেক জনিক নকরেককে নিয়ে। সাংসারেক হল গারো বা মান্দিদের আদি ধর্ম।

গারো বা মান্দিদের প্রায় সবাই খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেলেও ১১৬ বছর বয়সী জনিক নকরেক সাংসারেক ধর্ম ছাড়েননি। আদি ধর্মের সেই বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। গারোদের আদি এই ধর্মের রীতিনীতি পুরোপুরি মেনে চলেন তিনি। জনিক নকরেককে সবাই আচ্চু বলে ডাকে। মান্দিদের আচিক ভাষার আচ্চু শব্দটির বাংলা হবে দাদা অথবা নানা। মধুপুরের লাল মাটির গ্রাম চুনিয়াতে বসে এখনো একা একা নিজ ধর্ম পালন করছেন আচ্চু।

এবার মধুপুর ভ্রমণের সময়ে আমার পা পড়েছিল চুনিয়ায় সেই আচ্চুর উঠোনে। মূলত কবি রফিক আজাদের চুনিয়ার খোঁজে বেরিয়ে খুঁজে পেয়েছিলাম আচ্চুকে। বয়সের ভারে নিমজ্জিত আচ্চু এখনো বাস করেন মাটির কুঁড়েঘরে। তাঁকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র আন্তর্জাতিক মহলে সমাদৃত হয়েছে, বিশ্বের অনেক মানুষ চেনেন এই জনিক নকরেককে, কিন্তু তিনি এখনো সেই মাটির মানুষটি হয়েই বেঁচে আছেন চুনিয়ায়। যে চুনিয়ায় এসে গারোদের আতিথেয়তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি কবি রফিক আজাদ। চুনিয়ার প্রাকৃতিক লীলাভূমি আবেশিত হয়ে ফিরে এসেই লিখেছিলেন ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। এরপর বহুবার ফিরে ফিরে গেছেন চুনিয়ায়। আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানকার একমাত্র সাংসারেক জনিক নকরেকের এই কুঁড়েঘরেই।

ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তি জনিক নকরেক। তার সম্পর্কে বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, বাল্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গল্প শুনেছেন তিনি যৌবনে ব্রিটিশ শাসনের দাপট দেখেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন ভারত বিভক্তিও। ‘হাতমে বিড়ি মুখমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান শুনেছেন। মধুপুর থেকে ময়মনসিংহ চল্লিশ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা পায়ে হেঁটে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধীর জনসভায়ও গিয়েছেন তিনি। জনিকের জীবনের সবচয়ে বড়ো স্মৃতি ৭১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা বাংলোতে অবস্থানকালে বিরল সাক্ষাত। দোখলা বাংলোতে অবস্থানকালে চুনিয়া গ্রাম পরিদর্শনের সময় বঙ্গবন্ধুর পা পড়েছিল জনিকের এই জীর্ণ কুটিরে।

বয়সের ভারে নিমজ্জিত জনিক নকরেক এখনো কাউকে দেখলেই সে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করেন। করোনাকাল হওয়ায় আচ্চুর থেকে একটু দূরেই বসলাম আমরা। আমাদের দেখে কত স্মৃতিচারণা করলেন বিরবির করে। কোনোটা আমাদের কান অব্দি পৌঁছালো, কোনোটা পৌছালো না। কিন্তু ইতিহাসের কিংবদন্তী জনিক নকরেক আমাদের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে সেদিন। শান্ত চুনিয়ার শান্তিপ্রিয় মানুষেরা এখনো আগলে রেখেছেন তাদের আদি ধর্মের বাহক জনিক নকরেককে। জনিক নকরেক হারিয়ে গেলে কোথায় যাবে সাংসারেক ধর্ম? মান্দি জননগোষ্ঠী কি একদিন ভুলেই যাবে তাদের আদি ধর্মের কথা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)