ঘটনা এক.
অবৈধ অস্ত্র ও গুলি নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধে তেজগাঁও থানার এসআই আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে রাবেয়া খাতুনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেছিলেন ২০০২ সালের ২ জুন। এরপর এ মামলায় গ্রেফতার হয়ে ছয় মাস কারাগারে থেকে জামিন পান তিনি। ২০০২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে ১২ জনকে সাক্ষী করে রাবেয়াসহ দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০০৩ সালের ২৪ মার্চ শুরু হয় মামলার বিচার। মামলা থেকে মুক্তি পেতে ঢাকার আদালতে প্রায় ১৭ বছর ধরে ঘুরতে থাকেন বৃদ্ধা রাবেয়া।
‘অশীতিপর রাবেয়া: আদালতের বারান্দায় আর কত ঘুরবেন তিনি?’ শিরোনামে গত ২০ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আশরাফুল আলম নোবেল গত ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি আবেদন করেন। আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল হাইকোর্ট রাবেয়া খাতুনের বিরুদ্ধে থাকা মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করে মামলার নথি তলব করেন। সেই সাথে নিম্ন আদালতে থাকা মামলাটি কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। এরপর গত ১৫ মে হাইকোর্ট এক আদেশে রাবেয়া খাতুনকে আদালতে উপস্থিত করতে রিটকারি আইনজীবীকে নির্দেশ দেন। সে ধারাবাহিকতায় আজও (২৬ জুন) রাবেয়া খাতুন আদালতে হাজির হন।
আদালতে উপস্থিত হয়ে বৃদ্ধা রাবেয়া আদালতকে জানান, তার ন্যাশনাল আইডি অনুসারে তার বয়স ৯০ হলেও প্রকৃত বয়স প্রায় ১০৪ বছর। তার মানে ২০০২ সালে যখন ঘটনাটি ঘটেছিল তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৭৫ বছর।
ঘটনা দুই.
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ সালাম ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে তার মেয়েকে আনতে যাচ্ছিলেন। বিকাল ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী রোডে পৌঁছামাত্র মোটরসাইকেলে আসা ‘ছিনতাইকারীরা’ সগিরা মোর্শেদ সালামের হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি নিজেকে বাঁচাতে দৌড় দিলে তাকে গুলি করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে সগিরা মোর্শেদ সালাম মারা যান। ওইদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের স্বামী সালাম চৌধুরী। সগিরা মোর্শেদ সালামকে গুলি করার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা রিকশাচালক দুজনকে শনাক্ত করলেও অজ্ঞাত কারণে শুধু মন্টু ওরফে মরণের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় ডিবি পুলিশ।
এরপর ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আসামি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দীক। সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় সাতজনের। সাক্ষ্যে বাদীপক্ষ থেকে বলা হয়, এ মামলার তদন্তকালে আসামি মন্টু এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় মারুফ রেজা গ্রেপ্তার হন। কিন্তু মারুফ রেজার নাম বাদ দিয়েই চার্জশিট দেওয়া হয়।
সাক্ষ্যে মারুফ রেজার নাম আসায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই বছরের ২৩ মে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন বিচারিক আদালত। পরে ওই অধিকতর তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন মারুফ রেজা। রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। সেই সঙ্গে তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এরপর ১৯৯২ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট তার রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আরেকটি আদেশ দেন।
এ মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা সম্প্রতি বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের নজরে আনলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। তার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ ২৮ বছর পর অবশেষে সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার বিচারকাজ আবার শুরুর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
‘আইনের চোখে সবাই সমান’, দেশের সংবিধানের আলোকে এই ভাবধারা প্রচলিত। সংবিধানে তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশে ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ এই অধিকারটি শুধু অধিকারই নয়, মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তবে উপরের দুটি ঘটনা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়, তাহলে আমাদের উপলব্ধি বদলে যেতে পারে। আইনের চোখে সবাইকে সমান মনে নাও হতে পারে।
প্রথম ঘটনায় বর্তমানে ১০৪ বছরের বৃদ্ধা তার সময়ে ৭৫ বছর বয়সে ঘটে যাওয়া ঘটনায় অস্ত্র মামলায় আসামী হিসেবে অভিযুক্ত। আর দ্বিতীয় ঘটনায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় হিসেবে আইনের ফাঁকফোকর গলে ২৮ বছর ধরাছোঁয়ার বাইরে! একজন দরিদ্র ও সাধারণ নাগরিক এবং আরেকজন উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাবানের নিকটাত্মীয়।
আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু শর্ত ও পদ্ধতি আরোপ করে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কিছু শর্ত ও পদ্ধতির কথা বলা আছে যা পূরণ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রয়োগ করা যায়। আদালতের মাধ্যমেই মানুষের এ অধিকার প্রয়োগ করার বিধান আছে, যা রাষ্ট্র আদালতের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করে থাকে।
তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, আদালতের কাছে যাবার আগে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তদন্ত ও তাদের দেয়া প্রতিবেদনের মাধ্যমেই বিচারের পথ সুগম হয়। উপরের দুটি ঘটনায় তদন্তকার্য ঠিকভাবে হয়নি বললে খুব একটা ভুল হবে না বলা যায়, না হলে ৭৫ বছরের একজন বৃদ্ধার অস্ত্র মামলার আসামী হওয়া ও প্রায় ১৭ বছর ন্যায়বিচারের আশায় আদালতে ঘুরতে হতো না। আর ক্ষমতাবানের ক্ষেত্রে তদন্ত ও প্রাথমিক বিচারিক ব্যবস্থা তার পক্ষে ২৮ বছর রক্ষাকবচ হয়ে কাজ করেছে, যদিও শেষ সময়ে উচ্চ আদালত বিচারের পথ সুগম করেছে।
সংবিধান অনুসারে দেশের মানুষের শেষ ভরসা হচ্ছে আদালত। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু তদন্ত এবং মামলা-মোকাদ্দমার যুক্তি-তর্ক সম্পন্ন হলেই মানুষ তার ভরসার জায়গা থেকে প্রকৃত ও ন্যায় বিচার পাবে। বিষয়গুলো নিয়ে দায়িত্বশীল সবার ভাবার সুযোগ আছে, আরও কার্যকর নির্দেশনাও আসতে পারে উচ্চ আদালত থেকে। তাহলেই হয়তো দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতের পথ সহজ হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)