দেশে এখন আন্দোলনের অনেক ইস্যু থাকলেও দৃশ্যমান কোন আন্দোলন নেই। এমনকি দেশে নেই আমাদের প্রধান বিরোধীদলের প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি চিকিৎসার নামে দীর্ঘদিন ধরে সপরিবার লন্ডনে অবস্থান করছেন। ওখানে থেকে মাঝে-মধ্যে বাণী-বিবৃতি দিচ্ছেন। দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ভাষণ দিয়ে ‘সরকার পরিবর্তনের’ আহবান জানাচ্ছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস লন্ডনে সপরিবারে ভ্রমণ, থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, সাজ-পোশাক ইত্যাদির খরচা কোত্থেকে আসছে সে প্রশ্ন কেউ করছেন না।
তিনি বিদেশে বসে কোন নৈতিকতা বলে দেশের সরকার পরিবর্তনের ছবক দিচ্ছেন, সেটা নিয়েও কারও ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তিনি কোন ডাক্তারের কাছে কী চিকিৎসা নিচ্ছেন, এই চিকিৎসা কবে শেষ হবে, কবে তিনি দেশে ফিরে আসবেন, আদৌ ফিরবেন কি-না, এসব প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারছেন না। অবশ্য এসব প্রশ্নের জবাব কেউ খুঁজছে বলেও মনে হয় না। খেয়েদেয়ে সবারই তো কিছু কাজ আছে!
এ আজব দেশ। এখানে কারও কোন কাজের কোন রকম জবাবদিহি নেই। সবাই ফ্রিস্টাইলে ‘নিজস্ব নিয়মে’ চলছে। সরকারি দল আছে তাদের মতো। কোন সমালোচনাকে তোয়াক্কা না করে তারা পথ চলছে। নিজেদের বক্তব্য, যুক্তি ও আকাঙ্ক্ষা দিয়ে সাজাতে চাইছে সব কিছু। তাদের যুক্তি-বক্তব্য কেউ না মানলে তাকে কোন একটি বিশেষণ দিয়ে ‘আনফিট’ বা অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে।
আবার বিরোধী দল আরেককাঠি সরেস! তারা পরিণত হয়েছে ‘জাতীয়তাবাদী প্রেস ব্রিফিং দলে’। নিয়ম করে একটি ঘরে বসে দলের পাতি-নেতাদের একজন সাংবাদিকদের ডেকে এনে কিছু লিখিত-অলিখিত বাণী দেন। এর বাইরে যেন তাদের কিচ্ছু করার নেই! আর দলের প্রধান অন্য কাউকে দায়িত্বভার বুঝিয়ে না দিয়ে দিনের পর দিন বিদেশে কাটান। তাতে দলেরও কোন ক্ষতি হয় না! তাঁর নিজের ইমেজেরও কিছু হয় না। দলের এবং দলীয় নেত্রীর এ এক আজব কুদরতি !
বিরোধীদল এবং এই দলের প্রধান নেত্রী রাজপথে যৌক্তিক কোন ইস্যুতে কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে শোচনীয় রকম ব্যর্থ হলেও বাগাড়ম্বরে অব্যাহত সাফল্য দেখিয়ে চলছেন। সর্বশেষ তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘লেডি হিটলার’ আখ্যা দিয়ে তাঁর সরকারের পতন ঘটাতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাইকে সোচ্চার হতে বলেছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করে গড়ে উঠা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও একই মাধ্যম ব্যবহার করে পরিবর্তনের আহবান করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা বলেন, ‘আপনারা ফেসবুকে সজাগ থাকবেন, সোস্যাল মিডিয়া দিয়ে দেশে পরিবর্তন আনা সম্ভব, আরব বসন্ত তৈরি করুন’।
গত ১ নভেম্বর লন্ডনে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে দেয়া বক্তব্যে এমন কথাই বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সেসময় ছেলে তারেক রহমান পাশেই বসা ছিলেন।
বিগত সময়ের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলন ঢাকায় সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা শহরে বের হলেই গুলি করে দেয়। তবে সারা দেশে যে কী আন্দোলন হয়েছে, স্বাধীনতার সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তা হয়নি।
বেগম জিয়ার উল্লিখিত বক্তব্যটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে কেন ‘লেডি হিটলার’ বললেন-সে প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী ‘লেডি হিটলার’ হয়েছেন বলে তাঁর আপত্তি না তিনি নিজে সেটা হতে পারেননি বা পারছেন না বলে আক্ষেপ, সেটাও একটা রহস্য বটে!
তিনি ফেসবুকে সজাগ থেকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে আরব বসন্ত তৈরি করার আহবান জানিয়েছেন। নিজে ফেসবুক কিংবা সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করুন, সোস্যাল মিডিয়ার উপকার কিন্তু ঠিকই বুঝেছেন। তবে কথা এখানেও আছে। তার কথা মতো সবাই যদি ফেসবুকে সজাগ ও সোচ্চার হয়ে তথাকথিত ‘আরব বসন্ত’ আনেন, তখন তিনি ও তার দল কী করবেন? বসন্তের কোকিল হবেন? না বসন্তের সুযোগে ‘ভ্রমর’ হয়ে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াবেন? যারা ‘আরব বসন্ত’ আনবেন, তাদের তাতে কী উপকার হবে? মধুর ভাগ কি তারা পাবেন? সেই প্রতিশ্রুতি ও গ্যারান্টি কোথায়?
বিগত দিনের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরে বের হলেই গুলি করে দেয়! শাসকরা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গুলি তো করবেই! তাই বলে আপনারা পিছু হটবেন? তাহলে তো শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অনন্তকাল ধরে গুলি করতেই থাকবে, আর আপনারা কেবলই হা-হুতাশ চালিয়ে যাবেন! এটা কোন কাজের কথা হলো?
সে সময় সারা দেশে যে আন্দোলন হয়েছে, তা যদি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও না হয়ে থাকে, তবে তার ফল কোথায়? সরকারের পতন হলো না কেন? ক্ষমতাসীনদের ‘থাবা’ থেকে দেশ ‘স্বাধীন’ হলো না কেন?
আর হিটলার কিন্তু তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড দিয়েই ‘হিটলার’ হয়েছিলেন। কোন একটি বিশেষ দোষ বা গুণের কারণে হিটলার হননি। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে কি সত্যিই হিটলার বা ‘লেডি হিটলারের’ সঙ্গে তুলনা করা যায়?
এই সুযোগে আমরা হিটলার কে ছিলেন, তিনি কী করেছেন-এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করে নিতে পারি। আডলফ হিটলার ছিলেন অস্ট্রিয় বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ যিনি ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পাটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হিটলার ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতাধর ফিউরার ছিলেন। হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভাইমার প্রজাতন্ত্রে নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব লাভ করেন। অভ্যুত্থান করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে কারণে তাকে জেল খাটতে হয়েছিল।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে থাকেন। এভাবেই এক সময় জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হন। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাদের বিরোধী পক্ষের অনেককেই হত্যা করেছিল, রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছিল, সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেছিল এবং সর্বোপরি একটি সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল।
১৯৩৯ সালে জার্মানরা পোল্যান্ড দখল করে এবং ফলশ্রুতিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের অক্ষ শক্তি তথা জার্মান নেতৃত্বাধীন শক্তি মহাদেশীয় ইউরোপ এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু অবশেষে মিত্র শক্তি এ যুদ্ধে জয় লাভ করে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে জার্মানি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
হিটলারের রাজ্য জয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। কথিত আছে হিটলারের আমলে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে পরিকল্পনা মাফিক হত্যা করা হয়। ইহুদি নিধনের এই ঘটনা ইতিহাসে ‘হলোকস্ট’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া নানা অভিযোগে আরও প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ আছে। মুখে অনেকে হিটলারকে গালি দিলেও মনে মনে কিন্তু খুবই পছন্দ করেন। হিটলার অনেকেরই আদর্শ। বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদীদের। কারণ ধর্মীয় রাজনীতি মূল দর্শন-ই হল ফ্যাসিবাদ।
যেখানে একদল থাকবেন শাসক বা প্রভু। সকল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আরেকদল থাকবেন সেবক হিসেবে। তারা কেবল নিয়মের দাস হবেন। জো-হুকুম বলে মাথা নেড়ে কর্তার সব কথা, কাজ, চিন্তা, আচরণ, বিশ্বাসকে সায় দিয়ে যাবেন। তবে আধুনিক ফ্যাসিবাদ শব্দের উৎপত্তি ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের হাত ধরে। ফ্যাসিবাদ মনস্তত্ত্বের লক্ষণগুলো হল- নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা, নিজেদের অতীত ইতিহাসের যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা, ভিন্ন গোত্রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা, নিজেকে ছাড়া সবাইকে সন্দেহ করা।
বাংলাদেশে অনেকের কাছে হিটলার একজন আইকন। কারণ তিনি লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে দাস বানিয়েছেন, হত্যা করেছেন। তেমনি ভারতের ধর্মীয় নেতাদের কাছেও হিটলার সমানভাবে পূজনীয় কারণ; হিটলার ‘আর্য মতবাদ’ দিয়েছেন, রক্তের বিশুদ্ধতা শিখিয়েছেন, অন্যদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন।
হিটলারের জমানায় হিটলার ঘোষণা করলেন যে জার্মানরা যেহেতু বিশুদ্ধ রক্তের অধিকারী সেহেতু যুদ্ধে আহত কোন সৈনিক যেন ইহুদিদের রক্ত না নেয়। কারণ এতে রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হবে। এর জন্য জার্মানীতে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার আইন জারি হয়। ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য যে করেই হোক অন্যগোত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি। এর জন্য ধর্মের ব্যবহার করা হয়।
ধর্মই ফ্যাসিবাদের শিকড়। হিটলার ইহুদী বিদ্বেষ তৈরি করার জন্য প্রচার করতে থাকেন যে, ইহুদিরা ঈশ্বরপুত্র ‘যিশু’কে মেরেছে সুতরাং এই খেসারত বর্তমান প্রজন্মকে দিতে হবে, এবং দিতে হয়েছিল। হিটলার বলেছিলেন, আজ আমি যা করছি (ইহুদি নিধন) সেটা সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছানুসারেই করছি। ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমি ঈশ্বরের সৃষ্টিকেই রক্ষা করছি ! হায় হিটলার! হায় ঈশ্বর!
জ্ঞানী-গুণীরা বলেন, বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই নাকি একজন হিটলার থাকে। এই হিটলার যে কখন মাথা-চাড়া দিয়ে উঠবে-তা বলা যায় না। তবে প্রায় সময়ই ‘ভেতরের হিটলার’ জেগে উঠে। একটু খেয়াল করলে তা ধরাও পড়ে! থাক এসব তত্ত্বকথা। এখন প্রশ্ন হলো বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে ‘লেডি হিটলার’ বললেন কোন বিবেচনায়? প্রধানমন্ত্রী কী সত্যিই হিটলারের মতো হন্তারক? হাজার-হাজার লাখ-লাখ মানুষকে মেরে ফেলছেন? আমরা কেউ টের না পেলেও ‘সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী’ বেগম জিয়া ঠিকই টের পাচ্ছেন! নাকি তিনি নিজেই ‘হিটলারে’ আসক্ত হয়ে পড়েছেন, তাই সবার মধ্যে হিটলারকে দেখছেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)