১.
লুৎফর রহমান রিটনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বয়ান এই ছোট পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। দীর্ঘ সাহিত্য জীবন এক সাথে। সর্ম্পক একেবারেই পারিবারিক। রিটন ভাই চিরকাল সেলিব্রেটি। তিনি উপস্থাপক এবং ছড়া লিখে আর্কষণীয় জনপ্রিয়তার অধিকারী।
আমরা তার সাথে একত্রে থাকি। সংগঠন করি। লেখালেখি করি। নানা কাজে জড়িয়ে থাকি। রিটন ভাইয়ের স্ত্রী-যাকে আমরা আপা জ্ঞান করি। নাম শার্লি রহমান। বহু অভুক্ত দুপুর তিনি আমাদের আপ্যায়িত করেছেন। আন্তরিক ভাবে ভাত খাইয়েছেন। তখন আমাদের জীবন মাত্র শুরু হয়েছে। রিটন ভাইয়ের ছোট্ট সংসার । নদীর জন্ম হয়েছে মাত্র। ক্ষুদে নদী। সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়ায়। রিটন ভাই তখন পৈত্রিক বাসা ওয়ারিতে থাকেন। তখন কত দুপুর সন্ধ্যা রিটন ভাইয়ের বাসায় কেটেছে। সে সব এখন স্মৃতি।
রিটন ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকার বাইরে কতো ছড়া সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছি। কলকাতা বইমেলা, নিউইয়র্ক বইমেলা আর বাংলা একাডেমি বইমেলা লক্ষ হাজার স্মৃতির মধুর ভাণ্ড! একদা ঢাকা শহরে রিটন ভাইয়ের জোড় হিসাবে আমীরুল-এর নাম উচ্চারিত হতো। রিটন আমীরুল যেন অবধারিত একজোড়া নাম।
এ লেখা স্মৃতির আয়নায় নিজেদের দেখা নয়। রিটন ভাইকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। পূর্ণাঙ্গ একটা বই রচনার প্রয়োজন হবে।
আমরা রিটন ভাইয়ের ঈষৎ অনুজ। ৭৯-৮১ ব্যাচে ঢাকা কলেজে এক সাথে পড়েছি। রিটন ভাই আর্টসে আমি সায়েন্সে। পরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়েছি কিছুকালের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুজনেই স্নাতক করি। রিটন ভাই কলেজ জীবনেই বিবাহ করেন। তার জীবন সংগ্রাম শুরু হয় অল্প বয়সে। রিটন ভাই সাবালক হয়ে যান কিশোর কালেই। তরুণ বয়সেই তিনি স্টার। অল্প বয়সেই ছড়া লিখে খ্যাতিমান। অল্প বয়সেই তার প্রথম বই প্রকাশিত হয়।
২.
১৯৮২ সাল। আমরা ১৯৮১ সালে এইচএসসি পাশ করি। ৮২ সালে একুশে ফ্রেবুয়ারিকে কেন্দ্র করে তার ‘ধুত্তুরি’ প্রকাশ হয়। তখনও তারুণ্য শেষ হয়নি। ‘ধুত্তুরি’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজিমাত, ব্যাপক আলোচিত হয় বইটি। মনে আছে, তখন বিখ্যাত ছোটদের সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা। সেই কিশোর বাংলা ‘ধুত্তুরি’ বইয়ের একটি চমৎকার বিজ্ঞাপন নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। আমরাও তখন স্বপ্ন দেখা শুরু করি। একদিন আমাদেরও বই বের হবে। আমরাও লেখক হবো।
ধুত্তুরি প্রকাশ কালে শিশু একাডেমি একটা পুরস্কার প্রবর্তন করে। অগ্রণী ব্যাংক শিশু-সাহিত্য পুরস্কার। বছরের সেরা বই হিসেবে ভালো বইকেই পুরস্কার দেয়া হতো। লেখকের বয়স বা পদ মর্যাদার কোন ব্যাপার নয়। ‘ধুত্তুরি’ জমা পড়ল এবং অবধারিত ভাবে পুরস্কার পেল। রিটন ভাই তখন সেই কিশোর কালেই খ্যাতির তুঙ্গে। তার সফলতার পাল্লাও অনেক ভারি। ছড়াকার হিসাবে তখনই তিনি একক ও অদ্বিতীয়।
‘ধুত্তুরি’ প্রথম সংস্করণের কথা খুব মনে পড়ে। প্রচ্ছদ রিটন ভাই নিজেই করেছিলেন। সুন্দর প্রচ্ছদ। ভেতরে অনেকের অলংকরণ। ছোট-বড় অনেকগুলো ছড়া। লেটার প্রেসে ছাপা। দুই ফর্মার বই। ছোট্ট সাইজ। দ্বিতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ আঁকেন হাশেম খান। কতোবার যে সেই বই পড়েছি তার কোন হিসাব নাই।
তখন প্রতি বছরই রিটন ভাইয়ের দু’একটা বই বের হতো। উপস্থিত সুধীবৃন্দ, ঢাকা আমার ঢাকা দুটি বই পরপর বের হলো। রিটন ভাইয়ের প্রথম গল্পের বই ‘নিখোঁজ সংবাদ’। বের হলো তৎকালীন বিখ্যাত প্রকাশনা অনিন্দ্য থেকে। অনিন্দ্য থেকে রিটন ভাই আর আমি একটা কাজ করেছিলাম। শিশু কিশোর বার্ষিকী। নাম কিশোর অনিন্দ্য। সে সময় সংকলনটা ব্যাপক সাড়া জাগায়। নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ কিশোর অনিন্দ্য নিয়ে একটা রিভিউ লিখলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম প্রায় ১০০ কপি কিনেছিলেন পরবর্তী প্রজন্মকে উপহার দেয়ার জন্য।
তখন আমার বন্ধু মোহসীন করিম অপেশাদারী মনোভাব নিয়ে ঋতু প্রকাশন নামে একটা প্রকাশনী করে। সেখান থেকে রিটন ভাই আর আমি মিলে যৌথভাবে রাজাকারের ছড়া বইটা লিখি। দারুণ বিক্রি হয় বইটা। শিশির ভট্টাচার্যের আঁকা অনবদ্য প্রচ্ছদ। বইটার বিপণন করেন ফরিদ আহমেদ। সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী। এই বইয়ের কল্যাণে ছড়া তখন সাধারণ মানুষের চরম আগ্রহের বিষয়। রাজাকারের বিরুদ্ধে এই প্রথম কোন ছড়াগ্রন্থের প্রকাশ। পরবর্তীতে বইটার অনেক সংস্করণ হয়েছে। এখন অনন্যায় বইটা পাওয়া যায়। নবতর প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী হাশেম খান। এই বইটার প্রকাশকাল ১৯৮৮ সাল।
রাজাকারের ছড়াই প্রথম আলোচিত যৌথ ছড়াগ্রন্থ। বাংলাদেশের ছড়ার ইতিহাসে সেই বই এখন মাইলস্টোন। রাজনৈতিক ছড়া শুধু শ্লোগান নয় ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল তার প্রমাণ এই বই। রিটন ভাই হাজার হাজার রাজনৈতিক ছড়া লিখেছেন। এখনও কোন রাজনৈতিক ইস্যু তাকে পীড়িত করলে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ছড়া লিখে ফেলেন। গণমুখী ছড়া, হাস্যরসের ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া, বড়দের ছড়া– ছড়ার এক বিপুল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। বাংলা ছড়াসাহিত্যে তিনি অদ্বিতীয় প্রতিভা। প্রায় একাই তিনি সমৃদ্ধ করে চলেছেন আমাদের ছড়া সাহিত্য।
‘ধুত্তুরি’ প্রকাশের পর থেকে সাফল্যের স্বর্ণ দুয়ার উম্মোচিত হয়। তিনি আর পেছন ফিরে তাকাননি। পাঠকের ভালোবাসা, সমালোচকের সুদৃষ্টি, প্রকাশনার সৌভাগ্য সব মিলিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ছড়ার সুবাদে তিনি বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় জীবনের অধিকারী।
৩.
তার রক্তে ছড়ার দোলা, তিনি নিজেই বলেছেন, ধরাকে আমি ছড়াজ্ঞান করি। শতাধিক ছড়াগ্রন্থ তার প্রকাশিত হয়েছে। দুই খণ্ডের ছড়া সমস্ত। বড়দের ছড়া এক খণ্ড আরও দু’একটি সমগ্র প্রকাশের অপেক্ষায়।
ছন্দ-সুর আর বিষয়ের নবতর ভাবনায় তার ছড়া সবসময় পাঠকচিত্ত জয় করেছে।
তারা প্রাপ্তিযোগও অনেক। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে আর্শীবাণী দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ রিটন ভাইকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। ছড়ার জন্য তাকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ভালোবেসেছে। তার ছড়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলো না। অনেক বিস্তৃত লেখার ইচ্ছা রইল। সামান্য কয়েকটি শব্দে তা ধারণ করা যাবে না। অসম্ভব সাংগীতিক তার ছড়া। ছন্দ যেন অশ্বারোহীর মতো ছুটে চলে। আর হেন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি ছড়া লিখেননি। এর পাশাপাশি গদ্যও লেখেছেন অজস্র পরিমাণ। শতাধিক গ্রন্থের মধ্যেই জীবন্ত হয়ে আছেন রিটন ভাই।
জীবিত কালেই তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। ছড়া মানে রিটন এবং রিটন মানেই ছড়া। এ যেন সমার্থক হয়ে গেছে।
৪.
দীর্ঘ চল্লিশ বছর বেশি এক সাথে পথ চলা। কত কাহিনী, কত স্মৃতি। আমি রিটন ভাই, কবি আসলাম সানী, আহমাদ মাযহার, ধ্রুব এষ যেন এক পরিবারের অংশ। এক সাথে জীবনের পথে হেঁটেছি। পরিবারের মধ্যে বিবাদ যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার আমাদের মধ্যেও তেমন হয়েছে। আমাদের মধ্যেও নানা সময় মত পার্থক্য, ভুল-বোঝাবুঝি, মান-অভিমান হয়েছে। এইসব নিয়েই তো আমাদের স্মৃতিময় এই সামান্য জীবন। পরস্পরের মধ্যে অভিমান হয়েছে কিন্তু বিচ্ছিন্ন হইনি আমরা কেউ।
আমাদের এই দীর্ঘ পথ চলায়, শিশু সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে একটা জীবন আমাদের কেটে গেল। এর সত্যমূল্য নিশ্চয়ই আছে।
রিটন ভাইয়ের হাতে ছড়ার জয় পতাকা উড়ছে দীর্ঘদিনব্যাপী। বাংলা ছড়া সাহিত্যের তিনি চিরঞ্জীব সম্রাট।