চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

লুপ্তপ্রায় রামপ্রসাদী গানের মর্মস্পর্শী বেদনা

বাংলাদেশের যে সমাজে এবং পারিপার্শিকতায় বেড়ে উঠেছি, সেখানে কবিরঞ্জন সাধক রামপ্রসাদ সেন, সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য, সাধক বামাখ্যাপা, অথবা কণ্ঠ-শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গুণীজনদের জীবন-দর্শন বা কর্মকে চর্চার কথা দুরে থাকুক, তাদের জীবন-দর্শন এবং শিল্প-কর্মগুলোকে, এমনকি তাদের নামটা পর্যন্ত জানবার কোনো সুযোগ নেই ।

দৈনিক পত্রিকাগুলো বা ইলেকট্রনিক  মিডিয়াতে খুব কমই দেখেছি এনাদের সঙ্গীতকে তুলে ধরতে। ২৩ বছর  বয়সে দেশ ছেড়েছি, সত্যি কথা বলতে সেই দীর্ঘ ২৩ বছর পর্য্ন্ত দেশে থাকাকালীন খুব একটা সুযোগ মেলেনি বা কখনো অনুপ্রাণিত হইনি তাদের কাজ সম্পর্কে জানতে কারণ মুসলিম সমাজে আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা।

আজ প্রবাসী বাঙালি হবার পর যেন বাংলার অনেক অবহেলিত সাহিত্য, শিল্প-শিল্পী এবং সংস্কৃতিকে চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই এবং সে সব আরোও বেশি জানতে কৌতুহল বোধ করি। তবে আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটতে শুরু করে প্রবাসে কলকাতার কিছু বাঙ্গালীদের সান্নিধ্যে এসে। কলকাতার বাঙ্গালীদের সম্পর্কে জানবার সুযোগ বিদেশে আসবার আগে আমার ছিল না বললেই চলে। সত্যি বলতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কেও খুব একটা জানার সুযোগ আমার ছিল না।

যা হোক যেহেতু  গান ভালোবাসি এবং নিজেও একটু-আধটু গান করি; তাই রামপ্রসাদী সুরের প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল বৈকি! সম্প্রতি সেই রামপ্রসাদী সুরের টানে, সাধক এবং ব্যক্তি রামপ্রসাদকে  জানতে আগ্রহ হলো আমার সাস্কাটুন শহরের কলকাতা থেকে পড়তে আসা বন্ধু স্বরূপা চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে এসে। ইন্টারনেট এর বদৌলতে কিছু তথ্য-নির্ভর ওয়েবসাইট চোখে পড়ল এবং শুরু হলো আমার জ্ঞানের নতুন দুয়ার উন্মোচন এবং এক অন্যরকম উপলব্ধি।

সাধক রামপ্রসাদের জীবন কাহিনী পড়লে এবং তার সৃষ্টি-সমূহকে জানলে সহজেই বোঝা যায় বাংলা গান কতটাই  সমৃদ্ধ আর ঋদ্ধ। শুধু আজকের প্রজন্মেরই নয়, পুরোনো  প্রজন্মের অনেকেই আছেন যাঁরা আজও, রামপ্রসাদ সেনকে,  তা জানেন না। এটি সত্যি আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্য। যারা জানেন না তাদেরকে দোষারোপ করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

আমরা, যারা জানাবার দায়িত্ব নেইনি সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণে বা তার মতো সাধককে ‘হিন্দু সাধক’ বলে তাকে এবং তার সৃষ্টিকে অবহেলা করে লোকচক্ষুর অন্তরালে, বহুদূরে সরিয়ে রেখেছে  অথবা তার  মূল্যবান সৃষ্টিকে মূল্যায়ন করার জ্ঞান যাদের নেই, দোষারোপ করি তাদেরকে। আর তার কাজের সমাদর যেটি বর্তমানে উপস্থিত আছে সেটি খুবই ছোট পরিমন্ডলের মাঝে সীমাবদ্ধ। আশা করি এই লিখাটি কবি এবং সাধক  রামপ্রসাদ সম্পর্কে জানার তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মেটাবে।

১৮ শতকের শেষের দিকে বৈষ্ণব সঙ্গীতের খ্যাতি যখন কমে আসে,  কালি-ভক্ত রামপ্রসাদ সেন তখন  শাক্ত সঙ্গীতের সূচনা করেন। তিনিই অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি বাংলায় ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম ও দেবী কালীর বন্দনা বা  শ্যামা সঙ্গীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। রামপ্রসাদ সেন-ই প্রথম কবি যিনি এই প্রকার গভীর ভক্তিসহকারে, সহজ ভাষায়, দেবী কালীর বন্দনা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন।

তিনি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভক্তিগীতির রচয়িতা। দেবী  কালিকে ‘ভালবাসার মাতা’ হিসাবে তিনি খ্যাতিমান করে তুলেন। এই মা-শিশুর শাশ্বত প্রেমকে তিনি ‘প্রসাদি’  সুরে  রূপায়িত করেন। বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত ধারা বাউল ও বৈষ্ণব কীর্তনের সুরের সঙ্গে তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণীর মিশ্রণে তিনি বাংলা সঙ্গীতে এক নতুন সুর-মাধুরীর সৃষ্টি করে ভিন্ন এক  নতুন মাত্রা যোগ করে সঙ্গীতাঙ্গন কে সমৃদ্ধ করে তোলেন।  শ্রীযুক্ত করুণাময় গোস্বামী তার ‘বাংলা গানের বিবর্তন’ বইতেও একই  কথা  লিখেছেন। 

‘রামপ্রসাদি’ নামেই এই সঙ্গীত পরিচিত হয় । ‘প্রসাদি’ সুর  ছিল সাধারণ, ভীষণ সুরেলা এবং হৃদয় ছোঁয়া। কিন্তু তিনি এই সাধারণ সুরকে, বিভিন্ন রাগরাগিনীর সন্নিবেশে অসাধারণ করে তুলে, তাতে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। তার এই ছন্দরীতি কবি নজরুল পর্যন্ত, পরবর্তী অনেক  সাহিত্যিকরা  অনুসরণ করেন।

সঙ্গীত পরিচালকেরাও এই সঙ্গীতের আদলকে গ্রহণ করেন এবং সেটি এমন এক  উঁচু পর্যায়ে উঠে আসে যা কিনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও প্রভাবিত করে। রামপ্রসাদ সেন ছিলেন এক ধর্মনিষ্ঠ  কালীসাধক, যে কারণে তার সঙ্গীত ও কাব্য-প্রতিভা দেবী কালীর চরণে অর্পণ করেছিলেন। তবে তার সব গানই যে কেবল দেবী কালীর চরণে সমর্পিত -তা কিন্তু নয়।

তার প্রখ্যাত ‘কালিকির্তন’ ছাড়াও তিনি রচনা করে গেছেন তার অতিনন্দিত ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য এবং বিবিধ ‘কৃষ্ণকির্তন’। সাধক রামপ্রসাদ,  রামপ্রসাদ দেবী দুর্গার  মহিমা বা স্তুতিগানের মাধ্যমেও সাধারণ মানুষ এবং দেবতার মধ্যে এক সেতুবন্ধন রচনা করে গেছেন। সেটি  ‘আগমনি গান’ নামে পরিচিত ছিল  যার বিষয় ছিল- দুর্গা পূজার প্রাক্কালে দেবী দুর্গার স্বামীর ঘর কৈলাশ থেকে মর্তধামে, বাবার ঘরে আগমন।

সাধক, তার মায়ের আগমনের খুশিতে এবং মা দুর্গার বিদায়-যাত্রার বেদনায় আপ্লুত হয়ে গীত রচনা করেন। রামপ্রসাদের আগমনী গান জুড়ে ছিল এক দেবী- চরিত্রের গাথা, যেখানে তিনি  মা ধরনিকে মুক্ত করেন দানবকে বধ করার মাধ্যমে। রামপ্রসাদ, ঈশ্বর- ভক্তিকে এমন-ই  এক ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যান যা ঘরোয়া  জীবনের  হাসি এবং দুখের সময়কেও ভক্তিমূলক আঙ্গিকে তুলে ধরে।

যার ফলে তার গানগুলি সবার মাঝে পরিচিতি পায় ও প্রকারান্তরে, মানুষের হৃদয়ে এক বিশুদ্ধ আত্মিক সম্বন্ধযুক্তি ঘটায়। যুগে যুগে, বাউলরা এবং সাধকরা মানবিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আধ্যাত্মিক আত্মা হিসেবেই পরিগন্য হয়ে আসছেন। রামপ্রসাদের গানের বাণীতে শুধু ভক্তিই নয়, রয়েছে মানব জীবনের দুর্লভ অভিজ্ঞতা-লব্ধ দর্শন, গভীর ও চিরন্তন সত্যের প্রতি দিক নির্দেশনা । ইতিহাস থেকে জানা যায় যে  তৎকালীন বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে এই কালীভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব হয়।

তার গানেও এই সকল ঘটনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই কারণে, তার জীবদ্দশাতেই গানগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। রামপ্রসাদ সেন মূলত একজন কবি ছিলেন। কিন্তু তার বিশেষত্ব ছিল তিনি শুধু লিখতেই পারতেন না, গানও গাইতে পারতেন এবং সুরও সৃষ্টি করতে পারতেন!  তাঁর সবচেয়ে নন্দিত গানটির প্রথম  চরণগুলি উল্লেখ করছি : ‘মন রে কৃষিকাজ জান না; এমন মানব জনম রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা’।

এই গানটি  বাঙালির কৃষিসমাজের প্রতিচ্ছবি। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে কৃষিসমাজের সংযোগ অত্যন্ত  নিবিড়, যা আর বলবার অপেক্ষাই রাখে না। রামপ্রসাদের গান সেই বাঙালির কৃষিসমাজের নান্দনিক প্রতিনিধি।

রামপ্রসাদের পদাবলি আজও পশ্চিমবাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। কালীপূজার সময় এই গানগুলি নিয়মিত গাওয়া হয়। গবেষক সোমা চক্রবর্তী লিখেছেন, রামপ্রসাদের গান আজও “বেতারে সম্প্রচারিত হয় এবং কলকাতার পথেঘাটে আবালবৃদ্ধবণিতা, ব্যবসায়ী, পণ্ডিত, নিরক্ষর, সন্ন্যাসী, গৃহস্থ ও যুবকেরা তার গান গেয়ে থাকেন।”  যতটুকু জেনেছি,  ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পীরা  কলকাতার রামপ্রসাদী গানের বিশিষ্ট গায়ক।

আজও এই গানের সহজ সরল সুরে মুগ্ধ হয়ে অনেকে অশ্রুবিসর্জন করে থাকেন। কিন্তু আমি  বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পীর নাম বলতে পারব না যাঁরা রামপ্রসাদী গান করেন নিয়মিত, যদিও আমি নিজেকে সঙ্গীতাঙ্গনের একজন নিবীড় সত্তা বলে মনে করি। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা, বর্তমান সময়ের শিল্পীদের আধুনিক গান নিয়ে বা ব্যান্ড এর গান নিয়ে যে কোনো প্রশ্ন করলে অনায়াসে তার উত্তর দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু রামপ্রসাদী গান এর ধারক-বাহক কে, বা কা’রা, আমি নিশ্চিত তারা  তা’ আজ জানে  না,  যা’ নি:সন্দেহে লজ্জাস্কর।

অনেক অনুসন্ধানের পর জেনেছি যে শ্রীযুক্ত কিরণ চন্দ্র রায় কিছু রামপ্রসাদী গান করেন।  রামপ্রসাদী সঙ্গীতের মূল আকর্ষণ হল ভাব উদ্দীপক সুর-মাধুর্য্য। শুনলেই ভালো লাগায়, প্রশান্তিতে , ভক্তিতে চোখ কেমন বন্ধ হয়ে আসে। সেই সুরের প্রভাবে মনটা কেমন যেন  কোমল  হয়ে উঠে, মনে হয় যেন কোন অচিনপুরের ডাক শোনা  যাচ্ছে একটা স্নিগ্ধ, সুন্দর  অনুভুতি মনটাকে আচ্ছন্ন করে তোলে।

গানগুলির কথাও যেমনি বিশ্লেষণাত্মক,  তেমনি গভীর অর্থময় আগে জানতাম শিল্পীদের কোনো জাত ধর্ম থাকে না, সুরের কোনো জাত ধর্ম নেই বলেই আজও আমার বিশ্বাস। তাহলে আজ কেন এই গানের চর্চা বন্ধ হয়ে  গেছে ? আমরা শিল্পীরা কি পারিনা নিজেদের এই মানসিক  সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে ?  এই প্রশ্ন আমার পূর্বতম প্রজন্মের কাছে রেখে গেলাম।

রামপ্রসাদ সেন এর সময়কাল ১৭২০ থেকে ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ, অর্থাৎ  অষ্টাদশ শতক—যে শতকে বাংলার সমাজে একই সঙ্গে ভাঙন ও পরিবর্তনের সুর বাজছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৭৩৩-১৭৫৭) ক্রমশ আটকে যাচ্ছেন ইংরেজ বেনিয়া ও স্থানীয় রাজাকারদের ষড়যন্ত্রের জালে। তখন নদীয়ায় রাজত্ব করছিলেন মহরাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তার শাসনকালেই বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।

এমন এক পরিস্থিতিতে, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কুমারহট্ট গ্রামে, ১৭২০ সালে রামপ্রসাদ সেন জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শ্রীযুক্ত রামরাম সেন, যিনি নিজে সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন এবং ভেষজ ঔষুধের ব্যবসা করতেন। রামরাম সেন মহাশয়েরও কিছু কাব্য প্রতিভা ছিল বলে জানা যায়। যা হোক, রামপ্রসাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল গ্রামের সংস্কৃত টোল অবধি। এরপর তিনি পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন জীবন ও জীবিকার কারণে।

তবে তার ব্যবসার প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না, আগ্রহ ছিল কেবল সঙ্গীত ও কাব্য রচনার প্রতি। ব্যবসার প্রয়োজনে সংস্কৃত, ফারসি এবং হিন্দি ভাষা শিখতে হয়েছিল তাঁকে।  ফারসি ভাষার জ্ঞান তাঁর গানেও প্রভাব  ফেলেছিল, যেমন ‘মন রে কৃষিকাজ জান না’ গানটির একটি চরণ- ‘কালী নামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরুপ হবে না’।

এই ‘তছরুপ’ শব্দটি কিন্তু ফারসি।  রামপ্রসাদের অন্যান্য  আরও অনেক গানেও  ফারসি শব্দের উপস্থিতি দেখা যায়। পিতার অসময়ে মৃত্যুর পর তার পরিবার চরম দারিদ্রের সম্মুখীন হয়। বাধ্য হয়ে তখন তিনি কলকাতায় গিয়ে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী’র কাছারিতে এক সাধারণ হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু কাজের মাঝে- মাঝে তার হিসাবের খাতা ভরে যেত তার চির-আরাধিত কালি মা’র উদ্দেশ্যে রচিত মনরম গানে অথবা কাব্যে।

তার নিয়োগকর্তা বিষয়টি জানতে পেয়ে প্রাথমিক ভাবে অসন্তুষ্ট হলেও রামপ্রসাদের রচনার মধ্যে প্রস্ফুটিত অসামান্য সরল ভক্তি ও সাহিত্য দক্ষতাকে যথাযত মর্যাদাপূর্বক, তার নামে সহকর্মীদের নালীশ বাতিল তো করলেন-ই, উপরন্তু তাকে কাছারির সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে, তার নির্দিষ্ট মাসিক বেতন তার বাড়ী হালিশহরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করলেন। বাহ্ ! গুণের কদর করতে জানা একেই বলে! শুধু তাই নয়, নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রামপ্রসাদের কাব্য-প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে কবিবরকে নিজের রাজসভায় সভাকবি পদে নিযুক্ত করেন ও পরবর্তীকালে তাকে ‘কবিরঞ্জন’উপাধিতে ভূষিত করেন।

রামপ্রসাদী গানের ব্যাপারে প্রথম যেটা আশ্চর্য লাগে, সেটা হল অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রায়গুণকার ভারতচন্দ্রের সমসাময়িক এক কবি, প্রায় আধুনিক বাংলা ভাষায় কাব্য এবং গীত রচনা করে গেছেন। বাংলা গানে বা গীতিকবিতায় ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’ র মত সোজাসাপটা ভাষা সেই ২৫০ বছর আগে কেমন করে তিনি ব্যবহার করে গেছেন সেটা খুবি অবাক করার মতন বিষয়!

রামপ্রসাদের অনেকগুলি শ্যামাসঙ্গীতের সুর হুবহু এক। ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’, ‘কাজ কি মা সামান্য ধনে’, ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’, ‘এবার কালী তোমায় খাবো’, প্রভৃতি গানগুলির সুর একেবারেই অভিন্ন। এই বিশেষ সুরটির প্রভাব পরবর্তীকালে অনেক বাংলা গানে দেখা গেছে, যে সুরের টান ২০০/২৫০ বছর পরও বাঙালির হৃদয়ে অম্লান।

রামপ্রসাদী গানের মধ্যে বৈরাগ্যের যে অর্ন্তনিহিত সুর আছে তার প্রবল উপস্থিতি পাওয়া যায় লালনের মাঝেও। এই ধারাবাহিকতা নজরুল পর্যন্তও ছিলো। অনেক বাঙালি মুসলমানরা জানেন না নজরুল মা কালির গানও গেয়েছেন প্রচুর , নজরুলের রচিত শ্যামাসংগীত ও রয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের হাস্যরসাত্মক গানেও রামপ্রসাদী সুরের রেশ আছে, যেমন ‘প্রিয়ে তোমার ঢেঁকি হ’লে যেতেম বেঁচে’। অন্যান্য রবীন্দ্রসঙ্গীতে, যেমন ‘দেখব কে তোর কাছে আসে’এবং ‘আমিই শুধু রইনু বাকী/ যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি’–তেও একই সুরের বাঁধন।

রামপ্রসাদী সুরে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি দেশাত্মবোধক গানও আছে , যেমন: ‘শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা; পাষাণের মেয়ে পাষাণী তুই, না বুঝে মা বলেছি মা’ অথবা ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে, ঘরের হয়ে পরের মতো ভাই ছেড়ে ভাই ক’দিন থাকে’।

আজও বাংলাদেশের অনেকেই হয়ত জানে না, শ্যামাসংগীত কি? শ্যামাসংগীত হলো দেবী কালী বা শ্যামা বা শক্তি রূপিনি মা’র উদ্দেশ্যে রচিত এক ধরনের ভক্তিগীতি। এর অপর নাম শক্তিগীতি (Shaktigeeti )। বস্তুত, যেকোনো শক্তি রূপের উপাসনাতে বা পূজাতে যে গান ব্যবহৃত হয়, তাকেই শক্তিগীতি বলা হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ: দুর্গা, তারা, জগত্ধাত্রী, জগদম্বা , চন্ডি এঁরা সকলেই শক্তিরূপিনি দেবী। তাই এদেরকে উপাসনা করে গাওয়া গানগুলিকেও শক্তিগীতি বলা যায়। রামপ্রসাদের গানে আমরা একজন ‘মা’ কে পাই সব সময়। অনেকেই জানতে চান, তিনি কে? রামপ্রসাদের গানে যে মায়ের কথা রয়েছে, তিনিই কালী বা শ্যামা বা স্বয়ং মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি।

খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং একে ঘিরেই শক্তিগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারার প্রচলন ঘটে। শ্যামাসংগীত রচনার দ্বারা, রামপ্রসাদ, শক্তিগীতি চর্চার ক্ষেত্রে পুনরায় প্রাণসঞ্চার করেন এবং ভক্তিগীতি চর্চার ক্ষেত্রে নতুন এক অনুপম ধারার সৃষ্টি করেন।

রামপ্রসাদের চেষ্টা ছিল শক্তি সাধনাকে শুধু-মাত্র নীরস শাস্ত্রাচার ও তান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে তাতে একটি সহজ আবেদনপূর্ণ সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি দান করা। যেমন, ‘মন রে কৃষিকাজ জান না’ গানের শেষ দুটি চরণ এরকম- ‘গুরু বপন করেছেন বীজ, ভক্তি করি তায় সেঁচ না। তবে একা যদি না পারিস মন, রামপ্রসাদ কে ডেকে নে না’।

কবি নির্মলেন্দু গুণ এর ‘ও বন্ধু আমার’ কাব্যগ্রন্থে রামপ্রসাদী গানের সুরে তার লিখা দুটি গান এর উল্লেখ আছে।‘ও বন্ধু আমার’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত ‘রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক ১-২’ গান দু’টি তিনি লিখেছিলেন জগা সাধুর আশ্রমে বসে। মুজিব-হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা যখন গুণের প্রেমনিমগ্ন কবিচিত্তকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল, তখন তিনি মৃত্যুভয়ে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে সময় কাটাচ্ছিলেন বলে জেনেছি।

তার ব্যথিত-অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য তিনি তখন তাদের গ্রামের নদী তীরবর্তী শ্মশানঘাটে, জগা সাধুর আশ্রমে যেতেন নিয়মিত, যেখানে সংসার-ত্যাগী, শুভ্র জটাজুট ও শ্মশ্রুধারী জগা সাধু, ভক্তবৃন্দদের রামপ্রসাদী গান গেয়ে শোনাতেন। তার আশপাশের গ্রাম থেকেও সঙ্গীত ও সিদ্ধিপিপাসুরা ঐ আশ্রমে আসতেন। রামপ্রসাদের গান, গুণের গ্রামে খুব প্রচলিত ছিলো বলে জেনেছি।

তার লেখা থেকে আরো জেনেছি যে তার বাবাও রামপ্রসাদের গান গাইতেন। কিন্তু আমরা যারা শহরে এবং মুসলমান সংস্কৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে এসকল আশ্রম , পূজা এবং দেব -দেবীর ভক্তি সঙ্গীত একেবারেই অজানা এবং অচেনা এক জগত। আজকের বাংলাদেশের মানুষদের ভাষায় কাফের দের হারাম গান ! সেই আশ্রমে বসে রামপ্রসাদের গান শুনতে শুনতে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার মনকে শান্ত করতে করতে ব্যকুল হয়ে রামপ্রসাদী লোকসুরে কিছু গান লিখেছিলেন যদিও গান লেখাটি তার নিয়মিত কর্মের মধ্যে পরত না।

তেমনি আমার এই লেখা পড়ে কেউ যদি একটিও রামপ্রসাদী গান করতে বা শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠে তাহলে শান্তি পাব এই ভেবে যে আমাদের লোকসুরগুলো কখনো মরে যাবে না, অন্তত পক্ষে এই আশংকা থেকে মুক্তি পাব। আমাদের লোকসুরগুলো বেঁচে থাকুক আজীবন, সসম্মানে, নিজ মহিমায়। মহাবিশ্বের স্রষ্টার প্রতি যে ভক্তি বা ভালোবাসাকে আমরা যে নজরে দেখি, তাকে কি আমরা মানুষের প্রেমের সর্বোত্তম প্রতিভাসের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ব্যাখ্যা করতে পারিনা?

হোক না সেই স্রষ্টা বা ঈশ্বরটি হিন্দুদের বা মুসলিমদের বা জৈনের বা খ্রিস্টানের বা পরমাত্তায় বিশ্বাসী দের বা একেশ্বর বাদীদের বা বহুশ্বরবাদীদের বা , নিরীশ্বর বাদীদের বা সর্বেশ্বর বাদীদের! পৃথিবীর সকল আস্তিকদের হৃদিপদ্মে সেই একই স্রষ্টা প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু ডাকা হচ্ছে বিভিন্ন নামের মাধ্যমে এবং ধর্মীয় পরিচয়ে। তাঁর প্রতি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ভক্তি প্রকাশের ভাষাটি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু প্রেমের গভীরতাটুকুকে তুলনা করে কাউকে আঘাত দিতে চাই না।

সঙ্গীত কোথায় নেই? মায়ের মধুর হাসিতে, জন্মের পর যখন প্রথম কাঁদি—সেই কান্নায়, পাহাড়ের ঝরনার বহমান ধারায়, সমুদ্রের ঢেউ-এ, পাখীর ডাকে, বায়ুপ্রবাহে ও তা’তে আন্দলিত বৃক্ষপত্রের মর্মরধ্বনিতে, বৃষ্টির বর্ষণে, বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে সর্বত্র স্বত:সিদ্ধ এই সঙ্গীত ও সুর, সর্বদা বিদ্যমান রয়েছে। সুরের তো কোনো জাত-ধর্ম নেই, সে তো প্রকৃতির মাঝে সদা বিরাজমান, এক অন্তর্নিহিত অমুল্য দান।

তাহলে সুরকে কেন আমরা ধর্মের রঙ থেকে বের করে আনতে পারিনা? ভিক্টর হুগো’র মত সুবিদিত বিজ্ঞ বলে গেছেন “Music expresses that which cannot be put into words and cannot remain silent.” যুগে যুগে, মনিষীদের এই অমূল্য বাণী প্রণিধানযোগ্যই যদি হবে তো আজ কেন সুরের সাথে ধর্মের এই নিরর্থক বিরোধ ? গজল, হামদ -নাত বা সুফী গান কেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিল্পীরা গাইতে উৎসাহিত বোধ করেন না?

আর মুসলিম শিল্পীরাই বা কেন রামপ্রসাদের নিজের সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার কল্যাণে যে বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত চর্চার অনন্য সাধারণ ক্ষেত্র সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছেন, তাঁর সেই গান গাইতে বা শুনতে এবং এই অতিমাত্রায় সুমধুর সুরের ধারাকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন না আজ?

সাম্যর কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকে সাম্প্রদায়িকতাকে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। সেই মর্মকথা উপলব্ধি করে , বর্তমান সময়ের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে ঐক্যের ডাক তিনি দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়িত করতে পারেননি বলেই আজ একুশ শতকে সাম্প্রদায়িকতা নতুনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

কবি নজরুলকে কেউ কেউ মুসলমানের কবি বলে খুশি থাকতে চান। কিন্তু নজরুল কখনো নিজেকে কোনো ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন কিনা সেটা আমাদের সবার জানা। আবার একটা সময় পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রভাবে বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হিন্দুদের কবি বলে, রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা থেকে কিছু মানুষ দুরে ছিল এবং এখনো অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে দুরে থাকেন।

যদিও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেকে চিরকাল যে কোনো ধর্মীয় পরিচয় থেকে দুরে রেখেছেন আর অনেকেই হয়ত জানে না: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেচারা ব্রাহ্ম্ সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন , হিন্দু ধর্মের নয় ! সামাজিক ভেদ-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামী ও কুসংস্কার ইত্যাদি বহুবিধ মানবতা-বিরোধী কর্মকাণ্ডের চর্চার নানা ধরনের রূপ রয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে রামপ্রসাদী সুরের চর্চা হারিয়ে যাওয়াটা কোনও মতেই মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুদিন আগেও। কিন্তু আজ মেনে নিয়েছি কারণ জানতে পারলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দেশের সব পিস স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

গতকালকের (বুধবার) পিস স্কুল এর এক শিক্ষার্থীর বক্তব্য বাংলা ট্রিবিউনে পড়লাম “জাতীয় সঙ্গীত-ফাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন না। এসব আমরা গাই না। এগুলো ইসলাম বিরোধী কাফেররা গায়, আমরা না। আর ইসলাম হলো শ্রেষ্ঠ ধর্ম।”

কথাগুলো পড়তে গিয়ে আমি শোকাহত হয়ে প্রায় জ্ঞান হারাবার দশা হয়েছিল। আমাদেরকে ভাবতে হবে, ভাবতে শিখতে হবে,কল্পনা-প্রবণ হতে হবে, যুক্তি দিয়ে বাছ-বিচার করতে শিখতে হবে, আমাদের চারপাশের জগত সংসারের এই খোলা বইটিকে পড়তে শিখতে হবে, নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্নতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার কাজ ঘর থেকেই শুরু করতে হবে নইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হবে সেটাই স্বাভাবিক।