যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পর পুলিশ এখনও হত্যাকারীর উদ্দেশ্য সম্মন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা পায়নি। লাস ভেগাসে রুট নাইনটি ওয়ান নামের তিনদিনের কান্ট্রি মিউজিক ফেস্টিভালে কেন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, তা অনুসন্ধানে এখনও ‘হাজারটা পথ’ ধরে তদন্ত চালাচ্ছে তারা। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পাঁচদিন পর সেই বিভীষিকা এখনও প্রকট।
নেভাডার বাসিন্দা স্টিফেন প্যাডক (৬৪) নামের এক বন্দুকধারী পাশের মান্দালে বে হোটেলের ৩২ তলা থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়লে নিহত হন ৫৮ জন এবং আহত হন পাঁচ শতাধিক। সেই মিউজিক ফেস্টিভালে ২২ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিল। পরে প্যাডোক নিজেও আত্মহত্যা করে বলে পুলিশ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই হামলাকে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হচ্ছে।
পুলিশ জানায়, তারা এখন সবকিছুই বিবেচনা করছে, কিন্তু প্যাডক কেন এই হত্যাকাণ্ড চালালো তা নির্ধারণ করতে পারেনি।
লাস ভেগাস মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আন্ডারশেরিফ কেভিন ম্যকম্যাহিল বলেন, আমরা সবকিছুই তদন্ত করছি। আক্ষরিকভাবে সন্দেহাভাজনের ব্যক্তিগত জীবন, কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, তার সামাজিক আচরণ, আর্থিক অবস্থা এবং অনেকের দাবি মতে কোন সম্ভাব্য চরমপন্থায় তাড়িত ছিলো কিনা তাও। “আমরা সবাই উত্তর চাই।” শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
কিন্তু পুলিশ যখন সবগুলো ক্লু একত্র করার চেষ্টা করে তখন কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়, যার মধ্যে একটি কেন একজন সম্পদশালী, অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক এই ধরণের একটি অপরাধ করলো।
সে কেন এমনটি করলো?
লাস ভেগাস মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের শেরিফ জোসেফ লোবার্ডো বলেন, প্যাডোকের ম্যান্ডালে বে হোটেলের স্যুইট থেকে পাওয়া একটি কম্পিউটার এবং কিছু ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষা করে দেখছে পুলিশ। এছাড়াও নেভাদার মেসকুইট এন্ড রেনোতে তার বাসা থেকে পাওয়া কিছু প্রমাণও দেখছে তারা।
তদন্তকারীরা হোটেল স্যুইটের ভেতরে একটি নোটও পেয়েছে, যাতে একটি নাম্বার লেখা। কিন্তু পুলিশ জানাচ্ছে তা কোন সুইসাইড নোট বা কোন ঘোষণাপত্র নয়।
সে কোন চরমপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলো না বলেই ধারণা এবং সে পুলিশকে ফোন করে তার কাজের কোন ব্যাখ্যা দেয়নি, যেমনটি করেছিলো গত বছর অরল্যান্ডোর নাইটক্লাবে গুলি চালিয়ে ৪৯ জনকে হত্যা করা ওমর মতিন।
মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর এন্ড্রিও ম্যাকক্যাবি বুধবার বলেন, এই ঘটনাটি অতীতের অন্যান্যগুলোর তুলনায় ভিন্ন।
তার কি আরও হামলার পরিকল্পনা ছিলো?
গত ১৩ মাস ধরে ৩৩টি বন্দুক জোগাড় করেছিলো প্যাডক, যার অনেকগুলোতে বাম্প-স্টোক লাগানো হয়েছিলো বা অন্যান্য ডিভাইস যাতে বন্দুকটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মতো চালানো যায়।
সে ২৪টি অস্ত্র, হাজার হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ ১০ টি সুটকেসে লুকিয়ে হোটেল নিয়ে এসেছিলো এই ‘নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত’ হামলা চালানোর জন্য, পুলিশ জানায়।
প্যাডোক হয়তো হামলার জন্য অন্যান্য স্থানও বিবেচনা করেছিলো, যেমন রবিবারের হামলার আগের সপ্তাহে লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত হওয়া লাইফ ইজ বিউটিফুল মিউজিক ফেস্টিভাল। ওগডেনে উন্মুক্ত কনসার্টটির পাশেই একটি বহুতল ভবনের বিলাসবহুল ইউনিট ভাড়া করেছিলো প্যাডক।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম জানাচ্ছে, প্যাডোক হয়তো শিকাগোর লোলাপালুজা’র মতো অন্যান্য উৎসবেও হামলার পরিকল্পনা করেছিলো। আগস্টে হওয়া সেই উৎসবে লাখ লাখ মানুষের সম্মিলন হয়েছিলো।
সে বোস্টনের ফিনওয়ে পার্ক এবং বোস্টন সেন্টার ফর দ্য আর্টস এর আশেপাশের হোটেলও তার পর্যবেক্ষণে ছিলো বলে শুক্রবার জানান পুলিশ কমিশনার উইলিয়াম ইভান্স।
তার কি পালানোর পরিকল্পনা ছিলো?
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে শেরিফ জোসেফ লোমবার্ডো জানান, হামলার পর প্যাডক পালানোর পরিকল্পনা করেছিলো এমন প্রমাণ তারা দেখেছে। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি। পুলিশ তার স্যু্ইটে প্রবেশের আগেই প্যাডোক আত্মহত্যা করে।
আলবামা অপরাধবিজ্ঞানী এবং গবেষক অ্যাডাম ল্যাঙ্কফোর্ড বলেন, পালানোর কোন পরিকল্পনা সম্ভবত উদ্ভট কল্পনা। তিনি ১৯৯৯ সালে কলোরাডো হাই স্কুলে হামলা চালিয়ে ১২ জন শিক্ষার্থী ও একজন শিক্ষককে হত্যা করা এরিক হ্যারিস ও ডিলান ক্লেবোল্ড নামের দুই কিশোরের উদাহরণ টানেন, যারা পরে আত্মহত্যা করেছিলো। তবে তাদের দ্বিতীয় হামলার পরিকল্পনাও ছিলো।
ল্যাঙ্কফোর্ড বলেন, স্কুলে হামলার পর বেঁচে গেলে তারা একটি প্ল্যান হাইজ্যাক করে নিউ ইয়র্ক শহরেও হামলা চালাবে। হ্যারিস তাদের এমন পরিকল্পনা লিখে রেখেছিলো।
প্যাডোকের হোটেল রুমে ক্যামেরা লাগানো হয়েছিলো যাতে সে অন্যদের উপস্থিতি দেখতে পারে। এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো লাগানো হয়েছিলো যাতে সে জীবিত ধরা না পারে।
প্যাডোকের গাড়িতে ৫০ পাউন্ডেরও বেশি বিস্ফোরক দ্রব্য ছিলো, ১৬০০ রাউন্ড গোলা বারুদ এবং রাসায়নিক দ্রব্য ছিলো, যা দিয়ে সে বিস্ফোরক বানাতে পারতো, বিষয়টি ইঙ্গিত করে তার পালানোর পরিকল্পনার প্রতি।
এই হত্যাকাণ্ডের আগে বান্ধবীর জন্য ফিলিপাইনে যাওয়ার একটা প্লেন টিকিটও কিনেছিলো প্যাডোক এবং তাকে ১ লাখ ইউএস ডলার পাঠিয়েছিলো । কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, তার মৃত্যুর পর তার বান্ধবীর ভালোভাবে চলার নিশ্চয়তার জন্যই এমনটি করে প্যাডোক।
অন্য কেউ কি জড়িত?
পুলিশ প্যাডোকের বান্ধবী মার্লিও ড্যানলিকেও (৬২) জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ফিলিপাইন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার পর সে পুলিশকে সহায়তা করেছে। পুলিশের কাছে সে জানায়, প্যাডোকের এই পরিকল্পনার ব্যাপারে তার কোন ধারণা ছিলো না। টাকা পাঠানোকে সে ভেবেছিলো সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার ইঙ্গিত।
হামলাকারীর ভাই এরিক প্যাডক সাংবাদিকদের বলেন, তার ভাইয়ের সাথে কোন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দলের কোন সম্পর্ক নেই।
শেরিফ লোমবার্ডো আগেও ইঙ্গিত করেছিলেন এই ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত কিনা তা বিবেচনায় রেখেছে তদন্তকারীরা। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে প্যাডক সাহায্য পেয়েছিলো বলে ধারণা পুলিশের।