দুর্গাপূজা শেষে শুরু হয় লক্ষ্মীর আরাধনা৷ বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবার পূজিত হন মা লক্ষ্মী৷ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা আসলে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায়। শরৎকালের পূর্ণিমার রাত্রি বৎসরের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাত্রি। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই রাতে ধনসম্পদ, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী বিষ্ণুলোক হতে পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ‘কে জেগে আছ?’ এই প্রশ্ন করেন।
কোজাগর শব্দটির মধ্যেই রয়েছে এক দ্যোতনা৷কোজাগর মানে ‘কে জেগে রয়’? যে কারণে ঘুমে লক্ষ্মী হন বিরূপা, জাগরণে লক্ষ্মীর কৃপা৷ বাঙালির ঘরে লক্ষ্মী আসলে শিব-দুর্গার কন্যা৷ সরস্বতী তার বোন আর কার্তিক-গণেশ তার ভাই৷ আবার লক্ষ্মী রূপেরও দেবী। আবার ধনেরও দেবী৷ কিন্তু পুরাণ মতে, লক্ষ্মী দেবসেনা হিসাবে জন্মান, অনেকে আবার লক্ষ্মীকে গণেশের স্ত্রী রূপেও বর্ণনা করেছেন৷
লক্ষ্মীপূজার নানা সাজ-সরঞ্জামের মধ্যে এক বিশেষ উপাচার আলপনা৷ বাংলা ‘আলপনা’ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘আলিমপনা’ থেকে, যার অর্থ আস্তরণ প্রদান করা৷ পূজার আগের দিন আতপ চাল ভিজিয়ে রেখে পরদিন তা মিহি করে বাটার নিয়ম। বাড়ির সদস্যরা চালবাটা ও জল মিশিয়ে তৈরি করেন এক মসৃণ গোলা। এরপর একটুকরো ন্যাকড়া হাতের মধ্যে দিয়ে পিটুলিতে ডুবিয়ে মেঝেয় ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন লতাপাতার আঁকিবুকি৷ লক্ষ্মীপূজায় আলপনার প্রধান মোটিফ হল দেবীর পা৷ কোজাগরীর শুভক্ষণে বাঙালি হিন্দুর ঘরদোর উঠোন-সিঁড়ি সেজে ওঠে দুধসাদা পায়ের ছাপে৷ বাড়ির সদর দরজা অথবা পিছনের ঘুপচি দোর–মা লক্ষ্মী যেন সবসময় ঘরের ভিতরে ঢুকছেন–এভাবেই দেবীর পা আঁকার নিয়ম৷
মা লক্ষ্মী চঞ্চলা, তাকে স্থির করে, তুষ্ট করে, ধন-ঐশ্বর্যের আশীর্বাদ কামনা করাই পূজার উদ্দেশ্য৷ লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ তাই গৃহস্থের ঘরে ধনাগমের প্রত্যাশার প্রতীক৷কলমিলতা, ধানের শীষ, পদ্মপাতা, প্যাঁচা, শঙ্খলতা, সূর্য, লাঙল, মই, পানপাতা, সিঁদুরকৌটোও আলপনায় ফুটে ওঠে৷ এই সমস্ত ‘মোটিফ’ আদতে বাংলার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত জিনিসের প্রতিচ্ছবি৷ লাঙল, ধানের শীষ ভাল ফসলের কামনায় আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হতো৷তেমনই আনুষঙ্গিক যা কিছু শুভ তা-ই ফুটে ওঠে পূজার দিন৷
লক্ষ্মী হলেন ধনদেবী। মা লক্ষ্মী–ধনসম্পদের ঝুড়ি নিয়ে ঘর আলো করে থাকেন৷বাঙালি হিন্দুরা মেতে উঠে তার আরাধনায়–লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়ার আশায়৷ ফলমূল-নৈবেদ্যর পাশাপাশি অবশ্যই থাকতে হবে বিভিন্ন স্বাদের নাড়ু৷ মূলত নারকেল, চিনি ও এলাচের মিশ্রণে তৈরি হয় নারকেল নাড়ু৷ এছাড়া তিলের নাড়ু ও ক্ষীরের নাড়ু৷ নাড়ু না-হলে লক্ষ্মীপূজা জমে না৷ নাড়ু কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ গোপালের প্রিয়৷ ইনি নারায়ণের আরেক রূপ বলে আমরা জানি৷ আর নারায়ণই আবার লক্ষ্মীর স্বামী৷ তবে কি পতির প্রিয় খাবার বলেই নাড়ুকে লক্ষ্মী পূজার কম্পালসারি আইটেম বানানো হয়েছে?
কে জেগে রয়? নিশুত রাতে কোজাগরী পূর্ণিমার আলোয় মা লক্ষ্মী নাকি এমন ভাবেই দোরে দোরে কড়া নাড়েন৷ তা এই একরাতের ‘নাইট গার্ড’-এর কাজটি খুব সহজ সাদাসিধে নয় মোটেই, অন্তত দেবীচক্ষে। ভাগ্যে নিশাচর প্যাঁচা সঙ্গে ছিল! ড্যাবডেবে চোখওলা দুধসাদা বাহনটি দিনের বেলা তালকানা, এগাছ-ওগাছ হাতড়ালে কী হবে! সূয্যি ডুবলে ও-চোখেই যেন একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে ওঠে৷ বার্ডস আই ভিউতে তখন আঁধার চিরে জরিপ করে নেয়–কোন সংসারে বাড়ন্ত হলো ধানের ছড়া? কোন গৃহস্থের উঠোন জুড়ে ধনধান্যপুষ্প ভরা? আঁধার রাতের ওয়াচম্যান এই লক্ষ্মীপ্যাঁচাই তাই মা লক্ষ্মীর আসল পিএ। এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার কাম ড্রাইভার৷ চাঁদনি রাতে সে ধবধবে পাখা মেলেছে কি গেরস্থ বরণডালা, সিঁদুর, আসন-পিড়ি নিয়ে প্রস্তুত৷
কিন্তু কোথায় আজ মা লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা? আজকের যুগে এই ‘জনারণ্যে’ এমনকি গাছ-গাছালির কোটর খুঁজে-খুঁজে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ শহরে তো নেই-ই, গ্রামেও আর তেমন একটা লক্ষ্মীপ্যাঁচা দেখা যায় না। তবে পেঁচার সঙ্গে আমরাও ‘লক্ষ্মীছাড়া’ হতে চলেছি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)