এখনও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসতভিটায় দেশটির সেনাবাহিনী আগুন দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তাই ঘরবাড়ি, আপনজন আর জমি-জমা হারিয়ে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঢলও যেন থামছে না। কেননা প্রতিদিনই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
নাফ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এমনই এক হতভাগ্য রোহিঙ্গা নারীর নাম আছিয়া। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নৌকা ভাড়ার টাকা কম থাকায় আছিয়ার স্বামী সুলেমান স্ত্রী আর সন্তানদের এপাড়ে পাঠিয়ে দেন সকালে। বিকেলে তাদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এপাড়ে আসলেও স্বামীর অপেক্ষায় থাকা আছিয়া তাকিয়ে ছিলেন নিজবাড়ির দিকে। আছিয়া জানেন না আর কখনও তার স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে কি না। জানেন না তার স্বামী বেঁচে আছে নাকি সব মায়া ছিন্ন করেছে।
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে একটু দূরে দেখা মিললো এক বৃদ্ধার। সকালেই তিনি নৌকা ডুবিতে সন্তান হারাবার খবর পেয়েছেন। তবুও সন্তানকে জীবিত পাওয়ার আশায় সাগর পাড়ে অপেক্ষা তার। নাফ নদী নিজেই যেন এমন স্বামী সন্তান হারাদের কান্নায় ডুকরে উঠছে। হাহাকার আর বুকে বলতে গেলে পাথর বেঁধে দিন পার করতে হচ্ছে তাদের।
জঙ্গি হামলার অভিযোগ এনে গত ৩ সপ্তাহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এরইমধ্যে শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছে। ক্রমেই বাড়ছে এ সংখ্যা।
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপসহ অন্যান্য স্থান দিয়ে এ জনস্রোত বইছে। ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অস্বীকার করলেও বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বর্ণনাতে সবই স্পষ্ট। তাদের চেহারায় অত্যাচারের ছাপও অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়।
সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসে তারা হাঁটছে। শ্যাওলার মতো যেন ভেসে চলেছে অজানা অচেনা গন্তব্যে। কেউ টেকনাফ কেউ বা উখিয়ার শরণার্থী শিবিরের দিকে। ওরা জানে না ঠিক কোথায় গন্তব্য, কোথায় আশ্রয়। কী অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতের জন্য।
তবে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র দেখতে কক্সবাজার সফরের পর বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনে সংসদ নেতার সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন: প্রয়োজনে শরণার্থী হিসেবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ খাবার ভাগ করে খাবে; কিন্তু মিয়ানমারের মতো তাদের নাফ নদীতে ঠেলে দেবে না। সেই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন: আমি রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র দেখতে কক্সবাজার সফর করেছি। তাদের দুর্ভোগের কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এমন না যে, শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠিই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমাদের এখানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক ভালো ভালো পরিবার, সরকারি চাকুরিজীবী সবাই চলে এসেছে। তাদের দেখে শুধু আমার একটা কথাই মনে পড়েছে-৭১’এ পাকিস্তানী হানাদাররা আমাদের ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছিলো; রাখাইনেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী একই কাজ করেছে। আমরাও তো শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এদেরকে আমরা কিভাবে ফিরিয়ে দেই, মাননীয় স্পিকার?
রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন: আামি তাদের থাকার জন্য ২০০০ একর জমি দিয়েছি। বাঁশের সঙ্গে টিন এবং পলিথিন টাঙিয়ে থাকছে তারা। কিন্তু এভাবে কতো দিন। কিছুদিন পরই স্যানিটেশন সমস্যা তৈরী হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভাসান চরে তাদের জন্য অস্থায়ী বাসস্থান তৈরী করতে। এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নেভিকে। ১৬ তারিখে আমি জাতিসংঘে যাচ্ছি। সেখানে রোহিঙ্গাদের অবর্ননীয় দুর্ভোগের কথা তুলে ধরবো। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ব্যাপারে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠেছে।