মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র চরমপন্থি দল ‘আরসা’র বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে কমপক্ষে ৯৯ জন হিন্দু নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যার নতুন প্রমাণ মিলেছে বলে এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধান উদ্যোগের মুখে অ্যামনেস্টির নতুন এই প্রতিবেদন উদ্দেশ্যমূলক কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তিন মাস পর বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের এক বছর পূর্ণ হবে। সামর্থ্য না থাকার পরও তাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সঙ্কট সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মানবিক সংস্থা পাশে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের।
আর এর মাঝেই রাখাইনে হত্যাকাণ্ডের নতুন তথ্য প্রকাশ করল অ্যামনেস্টি।
সংগঠনটি জানিয়েছে, রাখাইনে তাদের পরিচালিত বিস্তারিত অনুসন্ধানে গত বছরের আগস্টে রাখাইন রাজ্যের অাহ নক খা মঙ সিক গ্রামের হিন্দু অধিবাসীদের ওপর অন্তত একটি হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া গেছে।এছাড়াও দলটি কিছু অপহরণের ঘটনা ওই সময় ঘটিয়েছে বলে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি।
একইদিন পাশের গ্রাম ই বোক কিয়ার থেকে ৪৬ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী নিখোঁজ হয় বলেও সংস্থাটি দাবি করে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের অধিবাসীদের বেশ কিছু সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করে ফরেনসিক প্যাথলজিস্টদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরির করার কথা জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
অ্যামনেস্টির দাবি, ২০১৭’র সেপ্টেম্বরে সন্ধান পাওয়া চারটি গণকবরে ৪৫ জনের মরদেহগুলো আহ নক খা মঙ সিক গ্রামের নিহতদের। কিন্তু, নিখোঁজ ৪৬ জনের তথ্য এখনো অজানা। এসব বিষয়ের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স বিষয়ক পরিচালক তিরানা হাসান ওই প্রতিবেদনে বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে আমাদের সর্বশেষ তদন্তের মধ্য দিয়ে উত্তর রাখাইন রাজ্যে আরসা পরিচালিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ওপর আলোকপাত করা সম্ভব হলো, যা খুব একটা প্রকাশ পায়নি।’
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের তুলনায় এই সংখ্যাটি অনেক ছোট হলেও সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মতোই এই বিষয়টিরও জবাবদিহিতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিরানা।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
তবে এই প্রতিবেদন আরসার দিকে বিশ্বনেতাদের মুখ ঘুরিয়ে মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টাও হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় গত বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। দাবি করা হয়, আরসার সশস্ত্র সদস্যরাই সেনাচৌকিতে হামলা চালিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত বহু মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমিয়েছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতে মারা গেছে অনেক রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনইউচসিআর-এর তথ্য অনুসারে, ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সহিংসতায় হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মারা গেছে। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি, সংখ্যাটি মাত্র ৪শ’।
তবে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সহায়তা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্তিয়েরস – এমএসএফ)-এর দাবি, গত বছরের ২৫ আগস্ট সহিংসতা ছড়ানোর পরবর্তী একমাসেই প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল।
প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর জরিপ চালিয়ে এই আনুমানিক হিসেবের কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
সেনাবাহিনীর হামলা ও সহিংসতার মাত্রার ভয়াবহতার কারণে জাতিসংঘ একে ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র একে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ‘জাতিগত নিধন কর্মসূচি’ বলে বর্ণনা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।