বেশ কয়েক বছর ধরেই ভূরাজনীতিতে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব আলোচনায় আসছে। অদূর ভবিষ্যতে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে বিশ্বশক্তিগুলোর যে প্রস্তুতি তার কৌশলগত কেন্দ্র বাংলাদেশ ও মিয়ানমার লাগোয়া বঙ্গোপসাগর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নানা তৎপরতা স্পষ্ট করে দিয়েছে, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল একটি বড় নিয়ামক। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘এশিয়ায় মাথা গলানো’র যেসব কৌশল ঝুলিতে নিয়ে রেখেছে, তার মধ্যে প্রধানতম হলো বঙ্গোপসাগরে নিজেদের কৌশলগত কর্তৃত্ব তৈরি করা। আর একে কেন্দ্র করেই ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো বলে, বড় শক্তির কৌশলগত কর্তৃত্বের আগে সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলে তৈরি হয় অস্থিরতা ও সন্ত্রাসী তৎপরতা। সাম্প্রতিক অতীতেই এসব আমরা দেখেছি। আর সে কারণেই বাংলাদেশকে ঘিরে যখন একের পর এক অস্থিরতা তৈরি হতে লাগলো, তখন এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়েই উদ্বেগ তৈরি হলো। তবে শেষ অবধি বাংলাদেশের অস্থিরতাকে পুঁজি করে আপাতত নেপোয় যে দই মারতে পারছে না, তা বছর দুয়েক আগেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যদিও নেপোয় বাবাজি তাতে ক্ষান্ত হয়নি। তবে এবার স্রেফ কৌশলটা বদলানো হয়েছে।
দেশ-দুনিয়া থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা, এক অদ্ভুত ব্যারাকীয় গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি করা মিয়ানমার সম্ভবত এখন সেই কৌশলের নিরাপদ গুটি হয়ে উঠতে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট যতো ঘনীভূত হবে, সেই কৌশল ক্রমেই কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। যদিও বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে এই সংকটের শিকার হয়ে আসছে। দলে দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে এসে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে। এ নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে কম কথা হয়নি। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বরং সংকট দিনকে দিন বেড়েছে। বলে রাখা উচিত, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মূল ঢল বাংলাদেশমুখী হলেও এর প্রভাব যে থাইল্যান্ড, ভারত, এমনকি ইন্দোনেশিয়াকেও ছুঁয়ে যাবে, তা অতীতে দেখা গেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে থামানো না গেলে সে দেশের ভেতরে যে আরো সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর নিপীড়নের তথ্য উঠে এসেছে, তার আঁচ সীমান্ত পেরিয়ে চীনে লেগে যাওয়াও বিচিত্র নয়। এই সংকট জিইয়ে রেখে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা কিংবা অর্থনৈতিক যোগাযোগের বলয় তৈরি করা সম্ভব নয়। প্রায়-মূর্ছিত সার্ক থেকে যখন বিমসটেক এ অঞ্চলের আঞ্চলিক সহায়তা ও নিরাপত্তার নতুন ক্ষেত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তখন রোহিঙ্গা সংকট পুরো বিমসটেক রাষ্ট্রগুলোর আন্তঃসম্পর্কের সমীকরণও বদলে দিতে পারে। বিশেষ করে বিশ্বসম্প্রদায়, এমনকি আঞ্চলিক বড় শক্তিও যদি বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই ঢল বন্ধ করতে যথাযথ উদ্যোগ না নেয়, তাহলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তঃসম্পর্ক নতুন চেহারা নিতে পারে।
বলা বাহুল্য, সেই ভাবনা বিমসটেকের সম্ভাবনার পথে বড় প্রশ্নবোধক তৈরি করে দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে নিঃসন্দেহে। কেননা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান আর পাকিস্তান ছাড়া সার্কভুক্ত অন্য সব রাষ্ট্রই বিমসটেকের বন্ধনে আবদ্ধ। এশিয়ার ভূরাজনীতিতে আরেক গুরুত্বপূর্ণ জোট আসিয়ান থেকেও মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড এই বিমসটেকে আছে। কাজেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অধিকতর সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই দুটি জোটের কোনোটিকেই কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক অস্থিরতার বলি হয়ে লাখো মানুষকে শরণার্থী হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিতে দেখেছি আমরা। মধ্যপ্রাচ্য তো তছনছ হয়েছেই, ইউরোপেও এই শরণার্থীদের ঘিরে সংকট তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠছে, এসবের জের ধরে সন্ত্রাসবাদের থাবা ইউরোপকে নাজেহাল করে দিতে পারে। কমিউনিস্ট খেদাতে ইসলামিস্টদের শরণ নেয়া আবার তাদের ঠেকাতে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান নায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সঙ্গী বৃটেন কিংবা ফ্রান্সও কিন্তু নতুন বাস্তবতায় নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি এড়াতে পারছে না।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, শরণার্থী সংকট ও আপাত ইউরোপের নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিকে আমরা যদি খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার করি, তাহলে একই শঙ্কা ভারত মহাসাগরের নিকটবর্তী এশিয়ার অঞ্চলগুলোর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। আজ হয়তো রোহিঙ্গা সংকটের আঁচ প্রত্যক্ষভাবে সবার ওপর আসছে না। কিন্তু ইউরোপের মতোই একসময় তা পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলোকে এই সংকটের প্রকৃত চেহারা যথাযথভাবে বুঝে উঠতে হবে। নানা সমীকরণে ভারত এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘ব্যালান্সড’ কূটনীতিতে থাকতে চাইছে। কিন্তু তাদের এই কৌশল অদূর ভবিষ্যতে তাদের বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল যদি বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার কবল থেকে ভারত কি খুব বেশি নিরাপদ থাকতে পারবে? সার্কের প্রায়-অস্তমিত সূর্য যদি বিমসটেকে ওঠে, তাহলে সেখানে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ থাকছে না। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট যদি বিমসটেকের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ যে পথে হাঁটবে, তা ভারতের জন্য সুখকর নাও হতে পারে।
ভুলে যাওয়া সমীচীন হবে না যে, অতি সম্প্রতি জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ার দিকে যাওয়ার কৌশল তৈরি করেছে। রাশিয়ার ভেতরে তাদের কিছু যোগাযোগও তৈরি হয়েছে। আইএস’র এই মডিউলটির প্রথম টার্গেট সাবেক সোভিয়েতভুক্ত মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রগুলো এবং রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। আইএস যা চাইছে, তা তারা করতে পারুক বা না পারুক, তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা ইউরোপ থেকে এশিয়ায় প্রবেশপথ সন্নিহিত অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে খুব সহজে। ঠিক এমন সময়ই যদি এশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গা সংকটকে পুঁজি করে নতুন কোনো অস্থিরতা তৈরি হয়, তাহলে তার ছোবল থেকে চীন কিংবা ভারত কেউই রেহাই পাবে না। এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলো কি এই বাস্তবতা মাথায় রেখে আগামীর পথ হাঁটবে, নাকি আপাত ক্ষুদ্র স্বার্থে চোখ বুজে থাকবে, তার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতির অনেক কিছুই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)