কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের একটি তাবুর ধূলিময় মেঝেতে এক রোহিঙ্গা নারী বসে আছেন চোখেমুখে অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে। বুকের ভেতর জমে থাকা তীব্র কষ্ট তাকে ঠিকমতো কথা বলতেও দিচ্ছে না।
তারপরও সাংবাদিকদের রাজুমা জানাচ্ছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে তার দেড় বছর বয়সী ফুটফুটে শিশুসন্তান সাদিকের নির্মম মৃত্যুর কথা: সেনারা আমার বাচ্চাকে আগুনের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিলো! মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ছবি আরেক দফা ফুটে উঠল আল-জাজিরার কাছে দেয়া রাজুমা বেগম নামের এই নারীর সাক্ষাৎকারে।
প্রচণ্ড কষ্টে কান্না চেপে তিনি খুঁটিনাটি বর্ণনা করলেন সেইদিনটির কথা, যেদিন সেনাবাহিনী রাখাইনের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম তুলাতুলিতে হামলা চালিয়েছিল।
‘সেনাসদস্যরা আমাকে আঘাত করার সময় আমার ছেলেটা আমার কোলে ছিল,’ কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন রাজুমা, ‘আঘাতে সে কোল থেকে ছিটকে পড়ে। তখন তারা একদিকে আমাকে টেনে হিঁচড়ে দেয়ালের কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, অন্যদিকে আমি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। কয়েক মিনিট পর আমি শুনতে পেলাম তারা (সেনা সদস্য) ওকেও আঘাত করছে।’
আঘাত করা পর্যন্ত তা-ও রাজুমার আশা ছিল তার সন্তানটিকে হয়ত আহত করে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু এরপর তারা যা করল সেটা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। সাদিককে কিছুক্ষণ আঘাত করার পর তাকে তুলে এক সেনা সদস্য হঠাৎই ছুঁড়ে ফেলে দেয় কাছে জ্বলতে থাকা আগুনের মাঝে। আগুনটা কিছুক্ষণ আগে সেনারাই জ্বালিয়েছিল। তারপর মা রাজুমাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে তারা।
নিজের কষ্ট ভুলে এখন ছেলে হারানোর শোকে বিহ্বল রাজুমা। হাসিখুশি, সারাক্ষণ খেলা আর দুষ্টুমি নিয়ে মেতে থাকা ছোট্ট একটি শিশু ছিল সাদিক। রাজুমা এখনো বিশ্বাসই করতে পারছেন না তার সেই চঞ্চল মায়াভরা ছেলে আর পৃথিবীতে নেই। আর কখনো তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারবেন না এই মা।
‘আমার ভেতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে,’ আর্তনাদ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজুমা।
রাখাইনে চলমান নির্যাতন আর নৃশংসতায় এই রোহিঙ্গা নারী শুধু তার নাড়িছেঁড়া ধনকেই হারাননি। হারিয়েছেন বাবা-মা, দুই বোন আর ছোট ভাইকেও। পরিবারে শুধু তিনি আর তার স্বামী মোহাম্মদ রফিকই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে পেরেছেন।
শুধু রাজিমা নন, বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া আরও অসংখ্য রোহিঙ্গা শরণার্থীর পরিবারেরই এমন পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে তারা বর্ণনা করেছেন তাদের ওপর হওয়া সব নির্যাতনের কথা। জানিয়েছেন, তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কীভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হয়েছে, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, একই সঙ্গে জীবন রক্ষার জন্য সেনাদের নির্দেশে কীভাবে চরম অপমানজনক বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে।
জাতিসংঘের হিসেব অনুসারে, গত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে সেনাবাহিনীর হামলা-নিপীড়নে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিন আরও মানুষ পালিয়ে আসছে প্রাণভয়ে। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিচ্ছে এবং দেশি-বিদেশি সংগঠনগুলোও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে। তবে এত বেশি সংখ্যক মানুষকে সহায়তা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ত্রাণ সংস্থাগুলো।