রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে এখন ছোট ছোট দোকান গড়ে উঠেছে। ফ্লাস্কের চা, পান-সিগারেট-গুল, চানাচুর, বিস্কুট, বিভিন্ন ড্রিংকস (স্পিড, টাইগার ইত্যাদি) বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে। দোকানগুলো প্যান্ডেল আকারের। পেছনটা ত্রিপালে আটকানো। উপরেও ত্রিপাল। তিনদিক খোলা। দোকানগুলো রোহিঙ্গা পুরুষদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। এই দোকানের টাকা কোথায় পেয়েছে, এমন প্রশ্নে উত্তরে নানান জন নানা ধরনের উত্তর দিয়েছে। কেউ বলেছে, ধারকর্জ করে টাকা ম্যানেজ করেছে, কেউ বলেছে, সামান্য কিছু টাকা তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, সেই টাকাতেই দোকান! কেউবা নিরুত্তর থেকেছে।
টেকনাফের উনচিপ্রাংয়ে আমরা এক দোকানে গিয়ে আড্ডা জমাই। অনেককেই পেয়ে যাই এই আড্ডায়। আমি জিজ্ঞেস করি, এই মুহূর্তে আপনাদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনটি? দেখলাম, তারা সবাই মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করছে। একজন বলল, আমাদের এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা মাছি! আমি ভাবলাম, মাছি বলতে সে গুরুতর কোনো সমস্যার কথা বুঝিয়েছে যার মানে আমি জানি না! তো আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাছি মানে? এবার সে একটা তার সামনে উড়তে থাকা একটি মাছি দেখিয়ে বলল, এই মাছি!
উপলব্ধি করলাম, তাদের মধ্যে শুধু চতুর নয়, সরল কিসিমের মানুষও আছে!
ওই ব্যক্তির উপর সঙ্গত কারণেই অন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তাকে থামিয়ে দিয়ে একজন বলল, আসলে আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি দরকার টাকার। টাকা হলে আমরা মাছ-মাংস-তরিতরকারি কিনে খেতে পারি। রিলিফে যা দেওয়া হয়, সেগুলো খেতে খেতে একঘেয়েমি এসে গেছে। এগুলো আর খেতে ভালো লাগে না।
এবার জিজ্ঞেস করি, টাকার বদলে রিলিফের প্যাকেটে আপনারা আর কি চান? এরপর নানাজন নানা আইটেমের নাম বলতে থাকে। কেউ বলে শুঁটকি মাছ, কেউ বলে বেশি পরিমাণে মরিচ, কেউ বলে মসলার কথা। কারও কারও চাহিদা ফেলং বা ফেলুর দানা, কেউবা খেসারির ডালের কথা বলেন।
আমরা যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখেছি, সেখানে ত্রাণ পায়নি বা না খেয়ে আছে, এমন পরিবার আমাদের চোখে পড়েনি। একজন সুস্থ্-সবল মানুষ বলছিল যে সে ত্রাণ পায়নি এবং ১৬ দিন ধরে না খেয়ে আছে! আমি বললাম, কেউ যদি তিন দিন না খেয়ে থাকে তাহলেই সে শক্তিহীন হয়ে পড়বে। হাঁটতে পারবে না। কিন্তু আপনি তো দিব্যি হাঁটা-চলা করছেন। এবার সে বলে, একটু একটু খাই! আমি বললাম, এই একটু খাবার কোথায় পান? এবার সে কাচুমাচু হয়ে বলে, এই এর-ওর বাসায়!
রোহিঙ্গারা অনেক ধকল সয়ে বাংলাদেশে এসেছে, কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম দিকে তাদের খাদ্য-আশ্রয় ছিল না-এটাও ঠিক। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন প্রায় সবারই খাদ্য এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রায় সত্তর ভাগ স্থানে পানি ও পায়খানার ব্যবস্থাও হয়েছে। যারা বলছেন, তারা খেতে পাননি, ত্রাণ পাননি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সহানুভূতি ও বাড়তি কিছু পাবার আশায় বলছেন।
তবে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব সেনাবাহিনী গ্রহণ করলেও এখনও পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। একই পরিবার একাধিক জায়গা থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করছে এমনটা হামেশাই ঘটছে। অনেকেই ত্রাণসামগ্রী খোলা বাজারে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বিক্রিও করছে। বিভিন্ন সংস্থার কর্মী, যারা সেখানে বিভিন্ন সেবা দিচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ সস্তায় রোহিঙ্গাদের কাছে ডাল, চিনি, তেল, আটা ইত্যাদি সামগ্রী কিনছেন-এমন দৃশ্যও আমাদের চোখে পড়েছে।
তবে অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, ত্রাণ বিতরণে সাম্য নেই। ১৪ সদস্যের পরিবারের জন্যও একটি টোকেন আবার চার বা পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্যও একটি টোকেন। আর প্রতি টোকেনের বিপরীতে একই পরিমাণের ত্রাণ প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে।
ত্রাণ নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মের কথা শোনা গেছে। ত্রাণ বিতরণে সুবিধার জন্য প্রতি ১০০ পরিবারের বিপরীতে একজন করে ‘মাঝি’ বা নেতা নির্বাচন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর মধ্যে যারা একটু চটপটে, আগ্রহী, নেতাসুলভ আচরণ করেন তাদেরই ‘মাঝি’ নির্বাচন করেছেন। এই ‘মাঝি’রাই সেনাক্যাম্পে যান। তাদের মাধ্যমেই টোকেন বিতরণ করা হয়। মাঝিরা এই টোকেন প্রতিটি পরিবারে পৌঁছে দেন। এই টোকেন দেখিয়ে পরিবারসদস্যরা ত্রাণ সংগ্রহ করেন।
কোনো কোনো আশ্রয় ক্যাম্পে মাঝিদের দাপট ও দুর্নীতির কথা শোনা গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই মাঝিরা টোকেন প্রদানের ক্ষেত্রে আশ্রিত পরিবারগুলোর কাছে টাকা নেয়। কেউ কেউ নিজের হাতে কিছু টোকেন রেখে দেয়। নতুন আসা রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে কিংবা স্থানীয়দের কাছে তারা টোকেন বিক্রি করে। এ ব্যাপারে তারা স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতা পায়। স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাঝিদের কাছে টাকার ভাগ নেন, এমন অভিযোগ বেশ কয়েকজন ত্রাণকর্মীর কাছে পাওয়া গেছে।
প্রতিটি ক্যাম্পকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ব্লকে একটি করে পরিচালনা কমিটি আছে। এই পরিচালনা কমিটির সদস্য হচ্ছেন মাঝি এবং স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তাদের কেউ কেউ মাঝিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেন এবং গোপন ভাগাভাগিতে অংশ নেন এমন অভিযোগও আমরা পেয়েছি।
স্থানীয় দরিদ্ররাও অনেকে রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচয় দিয়ে টোকেন নিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রভাবশালীরা সহযোগিতা করছেন। মিয়ানমার থেকে অনেক বছর আগে যারা বাংলাদেশে এসেছে, যারা নানা পেশায় যুক্ত হয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, সেসব রোহিঙ্গারাও এখন টেকনাফ ও উখিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে এসে টোকেন সংগ্রহ করে ত্রাণ নিচ্ছে।
অনেকেই নগদ টাকা দিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে ইসলামপন্থী বিভিন্ন গ্রুপের লোকজন রোহিঙ্গাদের মধ্যে অকাতরে টাকা বিলাচ্ছে। আশ্রয় শিবিরের অধিবাসীদের বেশ কয়েকজন বলেছেন, হুজুররা খুব ভালো। উনারা নগদ টাকা দেয়। এই টাকা দিয়ে তারা মাছ-মাংস কিনে খেতে পারে। তৈজসপত্র কিনতে পারে।
আমরা অনেক পরিবারকেই দেখেছি মাছ-মাংস রান্না করতে। তার মানে তাদের হাতে নগদ টাকা আছে। যদিও জিজ্ঞেস করলে সবাই বলেছে যে, তারা কোনো রকমে জান নিয়ে এদেশে এসেছে। তাদের বাড়িঘর টাকা পয়সা সব বার্মার আর্মিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে!
আগত রোহিঙ্গাদের প্রায় সত্তর ভাগই হচ্ছে শিশু। প্রতিটি তাবুর সামনে কিলবিল করছে ছোট ছোট শিশু। গড়ে প্রতিটি পরিবারে ৭/৮ জন করে বাচ্চা। যে পরিবারে বাচ্চা কম, সেখানে ৫জন! ১৯/২০ সন্তান আছে, এমন ব্যক্তিরও আমরা সাক্ষাৎ পেয়েছি।
এত বেশি সন্তান কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনটি ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। কেউ বলেছেন, সন্তান হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত। একজন নারী ১৯/২০ জন পর্যন্ত সন্তান জন্মদানে সক্ষম। এটা না করা মানে একজন মানবশিশুকে পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত করা। এটা গুণাহ্! আমরা এই গুণাহ্ করি না। আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবারপরিকল্পনায় বিশ্বাস করি না। এটা হচ্ছে খোদার উপর খোদকারী!
তবে যুবদের কেউ কেউ বলেছেন যে, বার্মায় আর্মিরা নারীদের উপর নির্যাতন চালাত। গর্ভবতী নারী হলে অনেক ক্ষেত্রে তারা নির্যাতন থেকে রেহাই পেত। তাই নারীরা যেন নিয়মিত গর্ভবতী থাকে, সেই ব্যাপারে তারা সজাগ থাকত!
আর ইউইনিসেফ-এর এক কর্মকর্তার মতে, কায়িকশ্রমনির্ভর ও কৃষিজীবী রাখাইন সমাজে একেকজন সন্তান হচ্ছে একজন করে শ্রমিক। পরিবারে কাজ ও আয়ের সহযোগী। সে জন্যই তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের চিন্তা নেই। বরং সন্তানের সংখ্যা বাড়ানোটাই তাদের আরাধ্য! আমরা সব মতই শুনলাম। মানলামও!
শুধু ওই নারীটির কথা ভেবে ব্যথিত ও বেদনাহত হলাম যিনি অসহনীয় বেদনা সয়ে প্রতি বছর একটি করে সন্তান জন্মদান করতে বাধ্য হয়েছেন এবং হচ্ছেন! আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা, পায়খানা, টিউবয়েল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের জায়গার অভাব হলেও মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের জায়গার কোনো অভাব হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে চার-পাঁচটা করে মসজিদ তৈরি হয়ে গেছে। রাতারাতি সব গায়েবি মসজিদ গড়ে উঠছে। কেউ কিছু জানে না, সকালে উঠে দেখে তাবুর সামনে একটা মসজিদ। কে বানালো, কোত্থেকে টাকা এলো তা কেউ বলতে পারে না! এগুলোর অবকাঠামোও বেশ উন্নত ও ব্যয়বহুল। মাদ্রাসাও তৈরি হচ্ছে। সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে কারা অর্থলগ্নী করছে তা আশ্রয় শিবিরের লোকজন বলে না!
খুব সম্ভব ইতিমধ্যেই তাদের মোটিভেট করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, হুজুরদের দেওয়া টাকায় এগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার স্থানীয় ত্রাণ কর্মীরা বলছেন, দেশের নানা প্রান্তের ধর্মবাদীরা এ ব্যাপারে অর্থ লগ্নী করছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিয়ে রোহিঙ্গাদের সহানুভূতি নিয়ে সেখানে মৌলবাদীচক্র জঙ্গি মতাদর্শে দীক্ষিত করার মতলব নিয়ে মাঠে নেমেছেন বলে স্থানীয় অনেক ত্রাণকর্মী অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি শঙ্কার।
এই ভাগ্যবঞ্চিত মানুষগুলোকে নগদ টাকা দিয়ে, পরকালের মোহে আচ্ছন্ন করে সহজেই জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয় বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ ব্যাপারে তারা কতটা সতর্ক ও সক্রিয়, এ প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তারা সব কিছু সরকার ও প্রশাসনের ওপর অর্পণ করেছেন! এসব ব্যাপার দেখার দায়িত্ব নাকি সরকার ও প্রশাসনের!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)