সন্তানসহ বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বহন করে অনেককেই বাংলাদেশে আসতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গা নারী হানিদা বেগমও জীবন বাঁচাতে তার ছোট্ট দুধের সন্তান আবদুল মাসুদকে নিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু পথেই ওই ছোট্ট শিশুটির নিঃশ্বাস চিরদিনের জন্য ফুরিয়ে যায়।
একমাস বয়স হয়েছিল আবদুল মাসুদের। মাসুদের মা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তার কোলের সন্তান মাসুদ আর নেই। সন্তানকে হারিয়ে মায়ের মাতম থামছেই না। শিশুটির দেহ বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মা হানিদা। হানিদা বারবার বলছেন তার সন্তান এখনই জেগে উঠবে। বার্তা সংস্থা এপি’র চিত্র সাংবাদিক তার ক্যামেরায় এ করুণদৃশ্য ধারণ করেন। হানিদা তা বিশ্বাস করতেই পারছেন না তার শিশুসন্তান আর নেই। এমন দৃশ্য দেখে উপস্থিত বাকিরাও চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি।
মিয়ানমার থেকে ছোট নৌকায় করে ওই রোহিঙ্গা নারী তার দুই সন্তানকে নিয়ে পারাপারের সময় নৌকাটি ডুবে গেলে আবদুল মাসুদের মৃত্যু হয়। তবে হানিদার আরেক সন্তান বেঁচে আছে। কিন্তু সন্তানের এভাবে মৃত্যু হানিদা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। সে তার সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। আর কাঁদছেন। আমার সামনে কয়েকজনকে জবাই করেছে আবার গুলি করেও মেরেছে। গুলি মারার পর যদি কেউ নড়তে থাকে তাহলে তাকে জবাই করে দেওয়া হয়। ঠিক এভাবেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা দেয় প্রাণে বেঁচে আসা রোহিঙ্গা যুবক ইদ্রিস।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কাছে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা যুবক ইদ্রিস সেখানকার পরিস্থিতি এবং নির্যাতনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জানায়, সেদিন বুধবার ছিল। বিকেলে আসরের নামাজ পড়তে বের হলে তাকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। রাখাইনের গারোতো বিলে তার বাড়ি। বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। চোখ খোলার পর বুঝতে পারে তাকে একটা গোয়াল ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন ওই ঘর ভর্তি তার আরও মানুষ ছিল, যাদেরকে তার মতই ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে সবাইকে গরুর রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। ওখানে দুইজন পাহারাদার ছিল বলে কারো বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। এদিকে তাকে প্রচন্ড মারধর করে আর মিয়ানমারে ভাষায় বলে ‘লো কালা’ অর্থাৎ তোরা আমাদের দেশি না, তোরা বাঙালি, তোরা ওখানেই চলে যা।’
ইদ্রিস জানান, তার সামনেই কয়েক জনকে জবাই করছে আবার কাউকে কাউকে গুলি করে মেরেছে। গুলি করার পর তখনো যদি কেউ নড়তে থাকে তাহলে তাকে জবাই করে দেয়। তবে সুযোগ পেয়ে এশার নামাজের সময়ে পাহারাদাররা দরজা থেকে সরে গেলে তখন তাদের অবস্থান দেখে ইদ্রিস পালিয়ে এসেছে। এছাড়া সে যখন ওইখান থেকে পালিয়ে যান সে সময়ও যাদের হত্যা করেনি তাদের সবার হাত-পা বাঁধা ছিল। তখনও ওখানে অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু শুধু ছিল পুরুষ মুসলিম, কোনো নারী ছিল না। তবে এরপর তাদের কি হয়েছে, তা সে জানেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্য রেখায় জন্ম নেয় চার শতাধিক নবজাতক। গত ১৫ দিনে রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত সহিংসতার মুখে পালিয়ে আসা চার লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগ হচ্ছে এসব শিশু। রোহিঙ্গারা পড়েছে ফাঁদে। সহিংসতার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের দায়ী করছে। জাতিসংঘ পরিস্থিতিকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করেছে আর সাহায্য সংস্থাগুলো ‘বিহ্বল’ হয়ে পড়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ৮০ শতাংশই নারী আর শিশু। আর পালানোর মুখে জন্ম হচ্ছে নতুন নবজাতকের। এসব নতুন মায়েদের একজন ২৫ বছরের সুরাইয়া সুলতান। সীমান্তের শুণ্য রেখায় তার প্রসব বেদনা উঠলে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) তাকে একটি নৌকায় নিয়ে যায়। আয়েশা নামে আরেক নারী শাড়ির আড়ালে তাকে সন্তান প্রসব করতে সাহায্য করেন। অসুস্থ আর বিধ্বস্ত হয়ে পড়া মা ও নবজাতককে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কাছের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে।
ওই শিবিরের কর্মকর্তা মো. মইনুল হক বলেন, ‘এরকম পরিস্থিতে পড়া আরও অনেককেই তারা পেয়েছেন। তাদের অনেকের অবস্থাই বেশ গুরুতর। আমরা তাদের সর্বাত্মক সাহায্যের চেষ্টা করছি কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের সামর্থের বাইরে।’ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন মা, আবার মা অসহায় হয়ে দেখছেন সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর অসুস্থতা কিংবা ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মারা যাচ্ছে নবজাতক।’
আরেক রোহিঙ্গা নারী মাসুম বাহাদুর। ২৮ বছরের এই তরুণী হারিয়েছেন তার সন্তান। তিনি বলেন, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কাঁপুনি উঠল তিন দিন বয়সী ছেলেটার। ওর বাবা আবু বকর (৩৫) ওকে নিয়ে ছুটে গেল সাহায্যের আশায় কিন্তু ফিরল মৃত সন্তানকে বুকে নিয়ে।’ আশেপাশের এলাকায় কোনো গোরস্থানও নেই। সব জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থীরা। বাধ্য হয়ে আবু বকর তার সন্তানকে জঙ্গলের মধ্যে ছোট একটি গর্তে সমাহিত করেন। আরেক নারী জানতেন না তার মৃত সন্তানকে নিয়ে কী করবেন। দুই দিন ধরে তাকে নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর পর বাধ্য হয়ে ছুড়ে ফেলেছেন নাফ নদীতে। গার্ডিয়ান এ খবরটি প্রকাশ করে। সংকট ছিলো পর্যাপ্ত খাদ্য আর পানির। মৌলিক চাহিদার অভাবে মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না।’ একজন রোহিঙ্গা বিধ্বস্ত হয়ে নয়াপাড়া ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে ছিলেন। তিনি আমাদের নিয়ে বাইরে গেলেন, কম্বলে ঢাকা ছোট একটি ঝুড়ির মুখ খুললে বেরিয়ে এলো সদ্য জন্ম নেওয়া দুটি অপুষ্ট শিশু।
তিনি জানান, পালিয়ে আসার পথে তার স্ত্রী দুই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সীমান্তের দুই পারের নারী ও শিশুদের জরুরী ভিত্তিতে সাহায্য দরকার। বাংলাদেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে চিকিৎসা কর্মীদের যেতে বাধা দিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। সেখানে প্রচুর শিশু এবং গর্ভবতী অসহায় অবস্থায় রয়েছে।
কক্সবাজার জেলার টেকনাফের কুতুপালং এলাকায় আশ্রয় নেয় সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় আমার। তারা জানায়, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে আসার কারণ। সেনাবাহিনী ও দেশটির বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের ওপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে, তা বর্ণনা করেছেন। পালিয়ে আসা একজন নারী বলেন, ‘রাখাইন থেকে আমাদেরকে কোথাও বের হতে দেওয়া হচ্ছিল না। যাওয়া-আসার ক্ষেত্রেও বাধ্যবাধকতা ছিল সবসময়। পালিয়ে আসার সময় দেখেছি, অনেক মানুষকে একসঙ্গে বোটে (নৌকা) তুলে তা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। ওখানে তারা (রাখাইনরা) কিছু অবশিষ্ট রাখেনি। ওখানে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করছে প্রতিদিন।’ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা তাদের দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন। পাশ থেকে আরেকজন নারী অনুনয়ের সুরে বলেন, ‘ওখান থেকে আরও মানুষ আসার চেষ্টা করছে। তারা আসতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
অনেকের বোট ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে আসতে পারছেন না।’ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের শোচনীয় অবস্থার প্রসঙ্গ তুলে ধরে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ বলেন, ‘যে যার যার মতো করে আমরা পালিয়ে এসেছি। দিনে আসার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। আমি গভীর রাতে পালিয়ে এসেছি। এসময়ও অনেকজনকে মগে (মিয়ানমারের অধিবাসী) ধরে নিয়ে গেছে।’ নিজের চোখের সামনে পরিবার-পরিজনকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থায় পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা একজন বলেন, ‘সেখানে (রাখাইনে) আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের অত্যধিক অত্যাচার করেছে তারা। খুন করেছে অনেককে। কারও সন্তানও মারা গেছে। আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি দৌড়ে পালিয়ে এসেছি বলে বাঁচতে পেরেছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে। ভাত-পানি কিছু খেতে পারিনি। স্ত্রী-সন্তান সব মারা গেছে সেনাবাহিনীর আক্রমনে।’ যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। একজন নারী বলেন, ‘বেশি অত্যাচার করা হয়েছে আমাদের ওপর। বলতে গেলে দশজনের মধ্যে নয় জনকেই তারা মেরে ফেলেছে। বাঁচতে পেরেছে মাত্র এক জন।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারা গুলি করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, মেরে ফেলছে আমাদেরকে। মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমার চোখের সামনেই পাঁচজনকে মরতে দেখেছি। বেঁচে থাকার সুবাদে এখানে আসতে পেরেছি। আমাদের পাড়া পুরোপুরি জ্বালিয়ে দিয়েছে।’
স্বজন হারানো মোহাম্মদ আমিন তাদের গ্রামের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘ওখানে পাড়ার চারপাশে মিলিটারিরা ঘিরে ফেলে গুলি করে, কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে মানুষদের হত্যা করে। আমরা তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। এসময় কারও মা, বোন মৃত্যুবরণ করেছেন তার ইয়াত্তা নেই। দেশ ছেড়ে পালানোর সময় যে যা পেয়েছি তা নিয়েই পালিয়ে এসেছি আমরা। কোনো বাড়ি থেকে একজন, কোনো বাড়ি থেকে দুইজন এভাবে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। বাকিরা মগদের (বার্মিজ) হাতে মৃত্যুবরণ করেছে।’ (চলবে)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)