রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের অজুহাতে গেল বছরের সেপ্টেম্বরে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয় কক্সবাজার জেলার জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম। সাময়িক বন্ধের আট মাস পার হলেও এখনো চালু হয়নি। কবে নাগাদ চালু হবে, তাও জানে না প্রশাসন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলাবাসী।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ২৫ আগস্ট থেকে টেকনাফ-উখিয়ায় রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। এ পর্যন্ত এসেছে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পরিচয়ে জন্মসনদ তুলে নানা কাজে লাগাতে পারে এই সন্দেহে স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন শাখার রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) জ্যোতির্ময় বর্মণ এক স্মারকমূলে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত জন্মসনদ প্রদান বন্ধ রাখতে নির্দেশনা জারি করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেই নির্দেশনা জেলার আটটি উপজেলার ৭১টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার মেয়র বরাবরে পাঠানো হয়। তখন থেকেই কেন্দ্রীয় সার্ভারে কক্সবাজার জেলার প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়।
জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা গত বুধবার (৩ মে) পর্যন্ত ১১ লাখ ১১ হাজার ৬২৭ জন।
সিভয়েসকে এতথ্য নিশ্চিত করেছেন বহিরাগম বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উপপরিচালক (উখিয়া-টেকনাফের দায়িত্বে থাকা) আবু মোহাম্মদ নোমান জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, গত ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে উখিয়া ও টেকনাফে ১২ টি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। এটি করছে বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী, বিজিবি,আনসার এবং ইউএনএইচসিআর এর কর্মীরা।
কক্সবাজারের চারটি পৌরসভা এবং ৭১টি ইউনিয়নে জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে স্থানীয়রা। কিছু জনপ্রতিনিধি ভোগান্তি রোধে বিকল্প প্রত্যয়নপত্র দিলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না।
ঈদগড় ইউনিয়নের রাজঘাট এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ‘সরকার আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয়ায় অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জন্মনিবন্ধন ছাড়া কিছুই মিলছে না’।
কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের মিজানুর রহমান বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধন না দেয়ায় অনেকের বিয়ে আটকে আছে। কারণ কাজী অফিসে জন্ম নিবন্ধন ছাড়া বিয়ে হচ্ছে না। অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারেনি। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ঘাটে-ঘাটে আটকে যাচ্ছে মানুষ’। তাঁর প্রশ্ন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য কেন আমাদের এত দুর্ভোগ পোহাতে হবে’।
কক্সবাজার পৌরসভার পাহাড়তলি এলাকার নুরুচ্ছফা বলেন, সম্প্রতি তিনি চিকিৎসা ভিসা আবেদনের জন্য চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারি হাই কমিশনারের কার্যালয়ে যান। সেখানে অন্যসব কাগজপত্র গ্রহণ করলেও স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেনি। শেষ পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন দিতে না পারায়, তাঁর ভিসা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, তাঁর আগে থেকে সংগ্রহে থাকা জন্মনিবন্ধনটি হারিয়ে যাওয়ার কারণে তিনি ভিসা পাননি। সেখানে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পৌরসভার প্রত্যয়নও গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, রোহিঙ্গা নিবন্ধন প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। কিন্তু তারপরও সার্ভার সচল করা হচ্ছে না। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় লোকজন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধন এখন প্রত্যেকেরই প্রয়োজন। আমরা যদি সতর্ক হই, তাহলে রোহিঙ্গারা কীভাবে জন্মনিবন্ধন পাবে?’
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে জন্মনিবন্ধন সনদপত্র দেয়া বন্ধ না করে বরং জনপ্রতিনিধিরাই সচেতন হলে এই সমস্যার সমাধান হবে।
মহেশখালীর কালারমার ছড়াই ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরিফ বলেন, জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় জনগণের যে কি পরিমাণ দুর্ভোগ হচ্ছে, সেটা দূর থেকে উপলব্ধি করার সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষ বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে (জনপ্রতিনিধি) গালিগালাজ করে। কিন্তু তাদের পক্ষে কিছুই করার নেই। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম দ্রুত চালু করার দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে উপরে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। শিগগিরই চালু করার চেষ্টা চলছে’।