ঈদের সকাল। ঈদের ঐতিহ্যবাহী চিনি ও দুধের মিশ্রণে সেমাই জাতীয় খাবার প্রস্তুতের জন্য অনেক সকালেই উঠেছেন শোরিয়া। এই অংশে খাবারটি সেভিয়ান নামে পরিচিত, কিন্তু তার স্বদেশ মিয়ানমারে এর নাম শাই মাই।
কয়েক ঘণ্টা পর, নিকটবর্তী ঈদগাহে নামাজ শেষে তার স্বামী সাবির এবং ছেলে রফিউল (৩) অন্ধকারাচ্ছন্ন জির্ণ ঘরটিতে আসে, যা তখনও তাদের কাঠের চুলার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। এখানে এই রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারটির জন্য কিছু ফলফলাদিও রয়েছে, কিন্তু মাংস বা ঝাল খাবার কোন নেই। সংস্কৃতিগত পছন্দের কারণ ছাড়াও আসলে এইসব খাবার যোগান দেওয়ার মতো অর্থ নেই তাদের।
যদিও শোরিয়া প্রথা অনুসরণের চেষ্টা করেন, কিন্তু সাউথ দিল্লির মদনপুর খাদার এলাকায় এই রোহিঙ্গা পরিবারটির জন্য নির্বাসনের এই ঈদ শুধুমাত্র যেনো আরও একটি দিন।
জাতিসংঘের মতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমরা ‘বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু’। সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ‘জাতিগত নির্মুলের’ অভিযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১৪ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম।
দেশটির রাজধানী দিল্লিতে শাহিন বাগ, মদনপুর খাদার, ওখলা এবং বিকাশপুরিতে অবস্থিত রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে থাকা ৯০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একজন সাবির। এদের কেউ কেউ টোকাই এবং মেথর, অন্যান্যরা বিভিন্ন এনজিও বা প্রাইভেট অফিসে খন্ডকালীন কাজ করেন।
রমজান মাসে তারা রোজা রাখেন কিন্তু তাদের জন্য সুস্বাদু খাবার অপেক্ষা করে না।
“আমরা কিভাবে ঈদ উদযাপন করবো, যখন আমাদের পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়দের এমন বিপদজনক পরিস্থিতিতে থাকতে হচ্ছে?” প্রশ্ন করেন সাবির।
সাবির ২০০৪ সালে ভারতে পালিয়ে আসেন এবং এর পর থেকে আর বাড়ি ফিরে যাননি। বর্তমানে তার স্ত্রী শোরিয়া, একজন রোহিঙ্গা, যার সাথে তার দেখাও হয়েছিলো এখানকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
রমজান মাসের প্রতিটা দিন এবং প্রতি ঈদে সাবির নিকটস্থ ঈদগাহে নামাজ পড়ে। কিন্তু প্রতিদিনের রোজার শেষে তার জন্য কোন লোভনীয়, সুস্বাদু খাবার অপেক্ষা করে না।
তার প্রতিবেশী জাফর, আরেকজন রোহিঙ্গা, সহিংস সংঘাতের কারণে যিনি ২০১১ সালে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। তারও উদযাপনের কোন মনোভাব নেই। কিন্তু এটা শুধু তার বাড়ি ফেরার জন্য আকুলতার জন্যই নয়।
তিনি একটি খবর পেয়েও আতঙ্কগ্রস্থ , তার ভাগ্নে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ‘বিদেশী এজেন্টদের’ তথ্য সরবরাহের অভিযোগে গত সপ্তাহে ছুরিকাহত হয়েছে।
ভারতে বসবাস করা তাদের জন্য নিরাপদ কিন্তু অনিশ্চয়তার হতাশাও যেনো গভীরতর। যেকোন সময় তাদের দেশে ফিরতে বাধ্য করা হতে পারে, এমন ভয় রয়েছে তাদের।
“আমরা মানুষদের সাথে দেখা করি এবং তাদের শুভেচ্ছা জানাই। আমরা একজন অপরজনকে সেভিয়ান দেই, কিন্তু দিনশেষে আমরা শরণার্থী এবং তা খুবই বিরক্তিকর।” বলেন জাফর।
এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচআরসি) পক্ষে কাজ করা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য আলী জহর বলেন, ভারত সরকার এই দেশে রোহিঙ্গাদের থাকার অনুমোদন দিয়েছে, তাদের স্বাস্থ্য কার্ড এবং শিক্ষার সুযোগও দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছরই তাদের রিফিউজি কার্ডটি নবায়ন করে নিতে হয়।
“মানবিকতার খাতিরে আমরা এখানে বাস করতে পারছি কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিশ্চয়তা নেই।” বলেন আলী।
জাফর, সাবির এবং অন্যান্যরা যখন একরাশ হতাশা নিয়ে তাদের স্বদেশের কথা স্মরণ করছে, তখন শিশুরা কিন্তু ঠিকই ঈদের উত্তেজনা সজীব রেখেছে, নিরন্তর হতাশার রাশ বারবারই টেনে দিচ্ছে তাদের প্রাণোচ্ছল হাসি।
নতুন জামা পরে এবং বড়দের কাছ থেকে ঈদি পেয়েই তারা খুব খুশী।
“আমাদের শিশুরাই শুধু খুশী, কারণ তারা মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানে না।” বলেন সাবির। তিনি একটি এনজিও-তে মাসিক ১২ হাজার রুপির বিনিময়ে কাজ করেন|
এই বছর যদিও তার সন্তান রফিউলের জন্য নতুন পোশাক কেনা তার জন্য ছিলো কষ্টকর। “আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই এবং মানুষের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইতেও পারিনা।”
রোহিঙ্গাদের জন্য এটা অনেক হৃদয়বিদারক যে তাদের সন্তানেরা, যাদের অধিকাংশেরই জন্ম ভারতে, তারা কখনোই ‘জাগো’ দলের সম্মন্ধে জানতে পারবে না। যারা সেহরির সময়ে মুসলিমদের ঘুম থেকে তুলতে গান গায়।
“বাড়ি ফেরার জন্যই আমাদের সকল প্রার্থনা। পরিবারের দুশ্চিন্তায় আমরা ঘুমহীন রাত কাটাই। বাড়ি থেকে দূরে, ভালোবাসার মানুষদের থেকে দূরে থেকে ঈদ কিভাবে হয়?” প্রশ্ন করেন শোরিয়া।
(সূত্র: দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)