রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগের তুলনায় হ্রাসের কারণে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক এলেক্স আর কুক।
তিনি বলছেন, বর্তমান ডেঙ্গুর প্রকোপ বোঝার জন্য আমাদের স্বাধীনতার পরের বছরগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলে উপকারে আসবে। পঞ্চাশ বছর আগে সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল মারাত্মক। তখন অধিকাংশ সিঙ্গাপুরবাসী অন্তত একবার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।
এলেক্স কুক বলছেন, ডেঙ্গু রোগের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো পরিস্থিতিটা দেখতে হবে। আধুনিক ভেক্টর নিয়ন্ত্রণের অভাবে এখানে অনেকগুলো সংক্রামক মশার অবস্থান লক্ষ্য করা গিয়েছিল। অধিকাংশ মানুষই তাদের দ্বারা সংক্রামিত হয়। তবে ধীরে ধীরে তা হ্রাস পায়। একসময় আমরা তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হই। কিন্তু বর্তমানে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে।
তার মতে, স্বাধীনতার কয়েক দশক পরে সিঙ্গাপুর সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে উত্তম ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ প্রচারাভিযান নিয়ে আসে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতা তৈরি, বাড়ি ঘরে প্রচারণা চালানো এবং জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে ডেঙ্গুর ব্যাপারে সচেতন করা গেছে। এতে করে এডিস মশার প্রজনন পাওয়া যায় এমন বাড়িগুলোর অনুপাত ১ বা ২ শতাংশে চলে আসে। মানুষ সচেতন হয়।
তিনি বলছেন, এই পরিবর্তনটি দেখার জন্য আপনাকে রাজধানীর যেসব অঞ্চলে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তার বাইরে গিয়ে তুলনা করে দেখতে হবে। তাহলে পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
এই গবেষক বলছেন, সিঙ্গাপুরের ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ প্রচারাভিযানটি তার প্রাথমিক বছরগুলিতে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছিলো। তখন সংক্রামক মশাগুলো খুব কম মানুষকেই সংক্রামিত করতে পেরেছিলো। কিন্তু সম্প্রতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো সিঙ্গাপুরের মতো একটি উন্নত রাষ্ট্রেও ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে ১৮৮ জন আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে ৫ জন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন ৪৫ জন।
এক্ষেত্রে অধ্যাপক এলেক্স কুক পরামর্শ দিচ্ছেন সংক্রমক এলাকার লোকদের উন্নত রক্ত পরীক্ষা চালানো দরকার, যেন আগে কেউ সংক্রামিত হয়েছে কিনা তার প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
এনইএ, এমওএইচ এবং সো সুই হুক স্কুল অফ পাবলিক হেলথের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় এই পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে সংক্রমণের মোট সংখ্যার প্রতিবেদনটির চেয়ে ৬ গুণ বেশি। একই গবেষণায় দেখা গেছে, যে রেকর্ডকৃত ক্ষেত্রে ১৪টি সংক্রমণের মধ্যে মাত্র একটি ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, মহামারী ও অনিয়ন্ত্রিত বছরগুলিতে পরীক্ষা দ্বারা পরিমাপ করা সংক্রমণের হার ১৯৬০ এর দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং ১৯৯০ এর দশকের পর থেকে বছরে প্রায় ১ শতাংশ মানুষ সংক্রামিত হচ্ছে।
এই প্রকোপের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সম্পর্কে মি. কুক বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিঙ্গাপুরে প্রাথমিক সাফল্যের পর থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ প্রাথমিক সাফল্যের প্রভাবটি আমরা ধরে রাখতে পারিনি এবং আগের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
এমতাস্থায় কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এই বিষয়ে একটি নিরাপদ, কার্যকরী এবং দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ দরকার। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়নি এমন লোকদের ডেঙ্গুমুক্ত থাকতে দীর্ঘস্থায়ী টিকার আওতায় আনা যেতে পারেও বলছেন তিনি।
এক্ষেত্রে ‘ওলব্যাকিয়া প্রজেক্টের’ কথা বলছেন তিনি। ‘ওলব্যাকিয়া প্রজেক্ট’ হলো ডেঙ্গু রোগ নির্মূলে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে মশার বিস্তার রোধের একটি প্রক্রিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদক্ষেপ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে।
‘এটি হলো এমন এক পদ্ধতি, যেখান পুরুষ এডিস মশার শরীরে ‘ওলব্যাকিয়া প্রজেক্ট’ নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো হয়। এরপর পুরুস মশাটি যখন স্ত্রী এডিস মশার সঙ্গে মিলিত হয় তখন স্ত্রী মশাটিও তার প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। ফলে ডেঙ্গু বহন করে এমন মশার হ্রাস পাবে।
এই প্রজেক্টের অধীনে এডিস মশার ঘনবসতি এলাকা চিহ্নিত করা হয়, সেখানে আমদানিকৃত মশা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা স্ত্রী মশার প্রজনন ক্ষমতা ধ্বংস করে এবং এডিস মশার বংশের মুলোৎপাটন হয়।
অধ্যাপক এলেক্স কুক বলছেন, এই প্রজেক্টটি সফল হলে পরবর্তী কয়েক বছরে আমাদের ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখতে পারি। এর ফলে আমাদের বাড়িতে মশার প্রজনন হ্রাস করতে পারি এবং প্রতিবেশী পরিবারের সুরক্ষার জন্যও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।