চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রেনুর নিষ্পলক চাহনি ও আমাদের মানবিকতা!

রেনু, দুই সন্তানের মা ছিলেন। এইতো গত পরশু রাতেও তিনি নিজের ঘরে ছোট ছোট সন্তানদের পাশে নিয়ে ঘুমিয়েছেন। রাজকন্যা- রাজকুমারের-দৈত্য -দানবের গল্প শুনিয়েছেন। সেই মা’টাও সন্তানদের সাথে তার ছোটবেলার গল্প করতেন, নিজের বাবা-মায়ের গল্প করতেন, ভাইবোনদের গল্প শোনাতেন।

নিশ্চয় তিনি সন্তানদেরকে ভবিষ্যতে সুন্দর দিনের স্বপ্ন দেখাতেন। সন্তানদের উৎসাহিত করতেন ভালো করে পড়াশোনা করতে, ভালো মানুষ হতে বলতেন।

এখন, রেনু শত ক্ষত দেহে নিয়ে একা শুয়ে আছেন কবরে। তার সন্তান দু’জন অন্য কারোর কোলে থেকে থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। “আম্মু আম্মু – কৈ তুমি” করে করো এ-ঘর ও-ঘর খুঁজছে। আবার খেলছে। ক্ষুধা লাগলে বাচ্চা দুটো আবার ডাকছে “আম্মু আম্মু – কৈ” বলে রান্না ঘর-বাথরুম-বারান্দা কিংবা শোবার ঘরে খুঁজছে।

কেন এইভাবে বাচ্চা দুটোকে একা করে দিলেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদে সন্তানরা এমনিতে নিঃস্ব হয়ে যায়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে (সঠিক পারিবারিক ও সামাজিক কাউন্সিলিং এর অভাবে)। এই বাচ্চা দুটো তাদের মা’কে আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতো নিশ্চয়। তাদের ছোট্ট পৃথিবীর সকল বিপদে-আপদে-অসুখে-বিসুখে এই বাচ্চা দুটো রেনু’মা কে আঁকড়ে থাকতো।

বাচ্চাদুটোকে কেন এমন নৃশংসভাবে মা-হারা করলেন। একজন “একলা মা”- বাংলাদেশের মতো জায়গায়- কত ভয়াবহ কষ্ট করে টিকে ছিলেন দুটো সন্তানকে ঘিরে। সেটা যে কোনো সুস্থ মানুষের বোধগম্য হওয়ার কথা।

অথচ, কিছু অসভ্য-বর্বর অমানবিক মানুষ তাকে জ্যান্ত মেরে ফেললো। এমন কি মরে যাওয়ার পরেও তাকে পেটানো হলো। কী নির্মম!  সেই সব আবার মোবাইল দৃশ্যায়ন করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হলো। কী নিষ্ঠূর!

আমি এই ঘটনার কোনো সঠিক উত্তর পাইনি। দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, ঘরে ঘরে টেলিভিশন, হাতে হাতে মোবাইল ফোন সাথে ইন্টানেট হয়েছে, সবার বাসস্থান, চিকিৎসা, বস্ত্র ইত্যাদি সব কিছুতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

কিন্তু, মানবিকতা দিন দিন তলানীতে চলে আসছে। রেনুসহ অন্যান্য সকল সন্দেহ বসত গণপিটুনির শিকার মানুষগুলোর দিকে তাকালেই সেটা বুঝতে পারি। শুধুমাত্র সন্দেহ করে আমরা এতটা নির্মম হতে পারি যে; মানুষ খুন করে ফেলছি। তাদেরকে আইনের হাতে তুলে দেয়ার কথা মাথায় আসছে না।

আমি রেনুর জায়গায় নিজেকে অনেকবার দেখার চেষ্টা করেছি ও দেখেছি। আমিও একলা মা ছিলাম ও আছি। অভিভাবকত্বের সকল দায়িত্ত্ব আমাকে একাই পালন করতে হয়েছে। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে, দেশ-বিদেশ সব জায়গায় ঘুরেছি ও ঘুরি। এখনও একাই সব করি। ভাগ্যিস, এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর মানুষদের চোখে আমি পড়িনি। যারা চাইলেই আমাকেও “ছেলে ধরা” সন্দেহ করে মেরে ফেলতে পারত।

একটু মানবিক হন, দয়া করুন।

রেনুর নিষ্পলক চাহনিতে আপনারা পুড়ে শেষ হয়ে যাবেন। শিশু তুবার কান্নার জলে – ভেসে যাবেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)